লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার গ্রাহকদের ওপর হঠাৎ করেই বেড়ে যাওয়া বিদ্যুৎ বিলের বোঝা নেমে এসেছে। অনেকের বিল এক মাসের ব্যবধানে দ্বিগুণ কিংবা তিন গুণ বেড়ে গেছে, যার কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারছে না পল্লী বিদ্যুৎ কার্যালয়। ফলে স্থানীয় জনগণ হতবাক, ক্ষুব্ধ এবং আর্থিক চাপে বিপর্যস্ত।
এমন অনিয়ম কর্মকাণ্ড শুধু লক্ষ্মীপুরে নয়, বরং দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় বেড়েই চলছে।
রায়পুর শহরের বাসিন্দা ও স্থানীয় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির গ্রাহক আবদুর রব ছিদ্দিকী জানান, তাঁর পরিবারের ঘরে মাত্র চারটি বৈদ্যুতিক পাখা ও চারটি বাতি আছে—এর বাইরে ফ্রিজ বা টেলিভিশনের মতো কোনো বৈদ্যুতিক যন্ত্র নেই। কিন্তু সেপ্টেম্বরে তাঁর নামে বিদ্যুৎ বিল এসেছে ৪ হাজার ৩৩ টাকা। আগের মাসেও কাছাকাছি পরিমাণ বিল দিতে হয়েছে, অথচ জুলাই মাসে তাঁর বিদ্যুৎ বিল ছিল মাত্র ৯৮৬ টাকা। এর আগের মাসগুলোতেও কখনো বিল এক হাজার টাকার বেশি আসেনি।
শুধু আবদুর রব ছিদ্দিকী নন, রায়পুর উপজেলার কয়েক হাজার গ্রাহকই একই ধরনের সমস্যায় পড়েছেন। তাঁদের অভিযোগ, দু–তিন মাস ধরে বিলের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেকে বিদ্যুৎ অফিসে অভিযোগ জানিয়েও কোনো কার্যকর সমাধান পাচ্ছেন না।
দেনায়েতপুর এলাকার বাসিন্দা ফয়েজ আহমেদ বলেন, “সাধারণত মাসে দেড় থেকে দুই হাজার টাকার মধ্যে বিদ্যুৎ বিল আসে। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে বিল এসেছে ৩ হাজার ৭৩ টাকা। বিদ্যুৎ অফিসে জানতে চেয়েও কোনো সঠিক ব্যাখ্যা পাইনি।”
রায়পুর উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা মিলিয়ে পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার। তাঁদের সেবায় প্রায় ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার লাইন স্থাপন করা হয়েছে। পল্লী বিদ্যুৎ কার্যালয়ের তথ্যমতে, গত মাসে রায়পুর কার্যালয় ১ কোটি ২৫ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ কিনে সরবরাহ করেছে—যেখানে আগের মাসগুলোতে সরবরাহ ছিল ৯০ থেকে ৯৫ লাখ ইউনিটের মধ্যে।
দেবীপুর গ্রামের আহমেদ কাউসার বলেন, “আমার প্রতি মাসের বিদ্যুৎ বিল ৭০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে থাকে, কিন্তু সেপ্টেম্বরে এসেছে দেড় হাজার টাকা। গ্রামের প্রায় সবাই একই অবস্থায় পড়েছে।”
চরপাতা, কেরোয়া ও সোনাপুর গ্রামের বেশ কয়েকজন গ্রাহক বলেন, মিটার রিডিংয়ের ভুল হিসাবের কারণে তাঁদের বিলে অস্বাভাবিক পরিমাণ যোগ হচ্ছে। বিদ্যুৎ অফিসে অভিযোগ জানাতে গেলে কর্মকর্তারা হয়রানি করছেন এবং ভুল সংশোধনে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না।
রায়পুর বাজার বণিক সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, “বাড়তি বিদ্যুৎ বিলের সমস্যা নতুন নয়। গত কয়েক মাস ধরে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ এই সমস্যায় পড়ছেন। অফিসে অভিযোগ জানালেও সংশোধনের তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। এতে ব্যবসায়িক ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে এবং সাধারণ পরিবারগুলোর ওপরও আর্থিক চাপ তৈরি হচ্ছে।”
গ্রাহকরা বলছেন, ভুল রিডিং বা অনিয়মিত মিটার রিডিংয়ের কারণে এই বিপত্তি ঘটছে। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, মিটারের ত্রুটি থেকেও হঠাৎ বিল বেড়ে যেতে পারে। ফলে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও নজরদারি জোরদারের দাবি উঠছে।
রায়পুর পল্লী বিদ্যুৎ কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “মিটার রিডিংয়ের ভুলের কারণে কিছু ক্ষেত্রে বিল বাড়তে পারে। অনেক সময় মাঠ পর্যায়ে কর্মীদের অসতর্কতার জন্য এই সমস্যা হয়। তবে অভিযোগ পাওয়া মাত্রই যাচাই করে ভুল থাকলে সংশোধনের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।”
রায়পুর জোনাল কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক মো. মোশারফ হোসেন বলেন, “বিল বেশি আসার কিছু অভিযোগ আমরা প্রায়ই পাই। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে বিল বাড়ানোর সুযোগ নেই। কোনো কারণে ভুল হলে তা দ্রুত যাচাই করে সংশোধন করা হয়। আমরা চেষ্টা করছি, যেন নির্ভুল হিসাবেই বিল প্রস্তুত হয়।”
তবে ভুক্তভোগী গ্রাহকরা বলছেন, কথার চেয়ে বাস্তব পরিস্থিতি আলাদা। অনেকে অভিযোগ করেও সপ্তাহের পর সপ্তাহ কোনো সংশোধনী পাননি। ফলে অনেকেই বিলের টাকা দিতে বাধ্য হচ্ছেন, পরে ফেরত বা সমন্বয়ের আশায়।
বিদ্যুৎ খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গ্রাহক পর্যায়ে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও মিটার রিডিংয়ের সঠিকতা নিশ্চিত না হলে এই ধরনের সমস্যা চলতেই থাকবে। তাঁরা বলছেন, প্রযুক্তিনির্ভর স্বয়ংক্রিয় মিটারিং ব্যবস্থা চালু করলে এ ধরনের অভিযোগ অনেকাংশে কমে যাবে।
স্থানীয় জনগণ এখন দাবি তুলেছেন—প্রতিটি এলাকার বিল পুনঃনিরীক্ষণ, মিটার রিডিং প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং গ্রাহক সুরক্ষা টিম গঠন করা হোক, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ অন্যায়ভাবে বাড়তি বিল দিতে বাধ্য না হয়।