স্থানীয় জনগণের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে আধুনিক আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করতে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ (জাগৃক) ২০২০ সালে কক্সবাজারে নির্মাণ করে ৪৬৯টি ফ্ল্যাট। লক্ষ্য ছিল নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের জন্য নিরাপদ, টেকসই ও স্বল্পমূল্যের বাসস্থান তৈরি করা। কিন্তু চার বছরের ব্যবধানে প্রকল্পটির চিত্র বদলে গেছে। সরকারি অর্থে নির্মিত ওই ফ্ল্যাটগুলোর বড় অংশ এখন পরিণত হয়েছে হোটেল ও রেন্টাল ব্যবসার কেন্দ্রে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, এসব ফ্ল্যাট স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য বরাদ্দ দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বাস্তবে ৫২ শতাংশ ফ্ল্যাট গেছে সরকারি কর্মকর্তা, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মচারী এবং সংরক্ষিত কোটাধারীদের দখলে। নিজেরা না থেকে তারা ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া দিয়েছেন পর্যটকদের কাছে, কখনও সরাসরি, কখনও হোটেল ব্যবসায়ীদের কাছে লিজ দিয়ে।
সরকারি আবাসন থেকে রেন্টাল ব্যবসা-
জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষের আবাসন সংকট নিরসন। কিন্তু বর্তমানে ওই ফ্ল্যাটগুলোর বেশিরভাগই বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা বিশেষজ্ঞদের ভাষায় “গুরুতর প্রশাসনিক অনিয়ম”। একদিকে আবাসন সংকটে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো ভোগান্তিতে, অন্যদিকে সরকারি আবাসন পরিণত হয়েছে লাভজনক ব্যবসার সম্পদে।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)-এর প্রতিবেদনেও এই চিত্র স্পষ্ট। প্রতিবেদনে বলা হয়, জাগৃকের ১০টি ভবনের মধ্যে নয়টি ভবনই এখন হোটেল বা গেস্ট হাউস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ১২০ জন ফ্ল্যাটমালিকের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে দেখা যায়, তাদের মধ্যে ১১৩ জন জানিয়েছেন, তারা নিজেরা না থেকে ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া দিয়েছেন। ভাড়ার অঙ্ক ১০ হাজার থেকে শুরু করে ৩১ হাজার টাকার বেশি পর্যন্ত।
কিন্তু স্থানীয় সূত্র বলছে, প্রকৃত আয় তার চেয়ে অনেক বেশি। কক্সবাজারের পর্যটন মৌসুমে এসব ফ্ল্যাটে একেক রাতের ভাড়া তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। ফলে মাসে আয় দাঁড়ায় এক থেকে দেড় লাখ টাকা। এভাবে সরকারি আবাসন প্রকল্প রূপ নিয়েছে ‘লাভজনক ভাড়াবাজারে’।
প্রকল্পের ইতিহাস ও গঠন-
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী ২০১২ সালে কক্সবাজারে প্রায় ৩৮ একর জমিতে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ১৭৬ কোটি টাকার ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় আটতলাবিশিষ্ট ১০টি ভবন, যাতে মোট ৪৬৯টি ফ্ল্যাট রয়েছে। ফ্ল্যাটগুলোর আয়তন ৫৫৯ থেকে ১ হাজার ৫৬ বর্গফুট পর্যন্ত বিভিন্ন রকম।
ফ্ল্যাটপ্রতি মূল্য নির্ধারণ করা হয় আয়তন অনুযায়ী—সবচেয়ে ছোট ৫৫৯ বর্গফুটের ফ্ল্যাট ৩৫ লাখ টাকা, আর সবচেয়ে বড় ১ হাজার ৫৬ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের দাম ৬৬ লাখ টাকা। প্রকল্পটির লক্ষ্য ছিল ‘আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন সাশ্রয়ী আবাসন’, কিন্তু এখন তা মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে বাণিজ্যিক ব্যবহারে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয়দের সুযোগ কোথায়-
জাগৃকের বরাদ্দ তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ৪৬৯টি ফ্ল্যাটের মধ্যে স্থানীয় বাসিন্দা বরাদ্দ পেয়েছেন মাত্র ৫৪ জন। বরং চট্টগ্রামের ১১৯ জন, ঢাকার ৬৬ জন এবং পাবনার ১৪৮ জন ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন। সব মিলিয়ে ৫০ জেলার নাগরিক এই প্রকল্পের ফ্ল্যাট পেয়েছেন। অর্থাৎ স্থানীয়দের জন্য ঘোষিত আবাসন পরিকল্পনা বাস্তবে পরিণত হয়েছে দেশব্যাপী বরাদ্দ উৎসবে।
এ ছাড়া ৫২ শতাংশ ফ্ল্যাট বিভিন্ন কোটায় বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১৮ শতাংশ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য, ২০ শতাংশ সংরক্ষিত কোটা, ৮ শতাংশ আধাসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মীদের জন্য, ৮ শতাংশ বেসরকারি চাকরিজীবী, ৭ শতাংশ প্রবাসী, ৪ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ৮ শতাংশ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, ৬ শতাংশ মন্ত্রণালয় ও জাগৃক কর্মকর্তা, ৪ শতাংশ বিশেষ পেশাজীবী এবং ৮ শতাংশ অন্যান্য কোটায়। স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয় মাত্র ৪ শতাংশ, অথচ প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্তরাই সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত বলে আইএমইডির প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মত-
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ মনে করেন, প্রকল্পটি নীতিগত ও অর্থনৈতিকভাবে ভুল ছিল। তিনি বলেন, “আমাদের দেশে অনেক সময় প্রকল্পের লক্ষ্যগোষ্ঠী সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হয় না। কক্সবাজার প্রকল্পও তার উদাহরণ। যাদের জন্য এটি করা হয়েছিল, তারা বরাদ্দ পায়নি। বরং যাদের কাছে ফ্ল্যাট পৌঁছেছে, তারা এটি ভাড়াবাণিজ্যে ব্যবহার করছেন।”
তিনি আরো বলেন, “কক্সবাজারের মতো পর্যটন এলাকায় সরকারি খরচে আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ করা যৌক্তিক ছিল না। কারণ বাজারের বাস্তবতা হলো, এখানে যে-ই ফ্ল্যাট পাবেন তিনি এটি দৈনিক ভাড়ায় দেবেন। এটি রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতা। যারা প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়নে জড়িত ছিলেন, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।”
স্থপতি ইকবাল হাবিবও একই মত দিয়েছেন। তার ভাষায়, “ভাসানটেকে নিম্নবিত্তদের পুনর্বাসনের নামে ফ্ল্যাট নির্মাণ করে যেভাবে ধনীদের দখলে চলে গেছে, কক্সবাজারেও একই চিত্র। জাগৃক তাদের মূল দায়িত্ব—নিম্নবিত্তের আবাসন—থেকে দূরে সরে গেছে। বরং রাজনৈতিক স্বার্থে প্রকল্পগুলো গড়া হচ্ছে পর্যটন এলাকায়।”
তিনি দাবি করেন, “যারা সরকারি ফ্ল্যাট নিয়ে ব্যবসা করছেন, তাদের বরাদ্দ বাতিল করতে হবে। একই সঙ্গে এমন প্রকল্প পরিকল্পনাকারী ও অনুমোদনদাতাদেরও আইনের মুখোমুখি করা জরুরি।”
আইএমইডি প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণ-
আইএমইডি প্রতিবেদনে কক্সবাজার প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এতে বলা হয়, “জাগৃকের কক্সবাজার প্রকল্পে উদ্দেশ্য ও বাস্তবতার মধ্যে স্পষ্ট ফারাক রয়েছে। স্থানীয় জনগণ এই সুবিধা পায়নি। বরং বরাদ্দপ্রাপ্তরা ফ্ল্যাটগুলো বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করছেন, যা প্রকল্পের মূল লক্ষ্য পরিপন্থী।”
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১২০ জন মালিকের মধ্যে ১১৩ জনই ফ্ল্যাট হোটেল হিসেবে ভাড়া দেন। ৩৭ জন মাসে ১০ থেকে ২০ হাজার, ৬৫ জন ২০ থেকে ৩০ হাজার, এবং ১১ জন ৩১ হাজার টাকার বেশি ভাড়া নিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তব আয় এর চেয়ে বহু গুণ বেশি। স্থানীয়দের ভাষায়, অনেক ফ্ল্যাট প্রতিরাতে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকায় ভাড়া যায়, যা মাস শেষে দেড় লাখ টাকারও বেশি আয় এনে দেয়।
প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়া-
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে জাগৃকের সচিব মনদীপ ঘরাই বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি জানেন না এবং উপপরিচালক বশির গাজীর সঙ্গে কথা বলতে বলেন। পরে বশির গাজী বলেন, “আমি বিষয়টি আপনার কাছ থেকেই জানলাম। আগামীকাল আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করব। যদি কেউ ফ্ল্যাট বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করে, তবে তাকে নির্দিষ্ট ফি দিতে হয়। সেই ফি দেওয়া হয়েছে কি না, তা যাচাই করা হবে।”
তবে গৃহায়ন বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি কেবল ‘ফি পরিশোধের বিষয়’ নয়, বরং নীতি লঙ্ঘনের ঘটনা। সরকারি আবাসন প্রকল্প বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য নয়—এই নীতি স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে সরকারি নথিতেই।
রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার ব্যর্থতা-
বিশ্লেষকদের মতে, কক্সবাজার প্রকল্প দেশের আবাসন পরিকল্পনায় একটি ব্যর্থ উদাহরণ। প্রথমত, এটি পর্যটনকেন্দ্রিক এলাকায় করা হয়েছে যেখানে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের হোটেল ও রিসোর্ট ব্যবসা আগে থেকেই জমজমাট। ফলে সরকারি প্রকল্প বাজারচাপেই বাণিজ্যিক ব্যবহারে ঢলে পড়েছে।
দ্বিতীয়ত, প্রকল্পের লক্ষ্যগোষ্ঠী—নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ—বরাদ্দ প্রক্রিয়া থেকেই বাদ পড়েছে। স্থানীয়দের অংশগ্রহণ না থাকায় প্রকল্পটি মূল উদ্দেশ্য হারিয়েছে।
তৃতীয়ত, এই প্রকল্পে বরাদ্দ প্রক্রিয়া ও তদারকিতে দুর্বলতা ছিল স্পষ্ট। সংরক্ষিত কোটার নামে মন্ত্রণালয়-নির্ধারিত বরাদ্দ ব্যবস্থা প্রকল্পকে রাজনৈতিক প্রভাবের অধীন করে ফেলেছে।
নৈতিক ও প্রশাসনিক প্রশ্ন-
ফ্ল্যাটগুলোর বাণিজ্যিক ব্যবহার শুধু প্রশাসনিক নয়, নৈতিকভাবেও প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ সরকারি অর্থে তৈরি ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্য ছিল জনকল্যাণ, লাভের উৎস নয়। পর্যটন এলাকার বাজারমুখী প্রভাব বিবেচনা না করে প্রকল্প নেওয়ায় এটি রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
স্থপতি ইকবাল হাবিবের ভাষায়, “এ ধরনের জনবিরোধী প্রকল্প জনগণের সঙ্গে প্রতারণা। এটি আবাসন নয়, দুর্নীতির আরেক রূপ।”
পরিশেষে, কক্সবাজারের জাগৃক প্রকল্প এখন সরকারি আবাসনের বদলে পরিণত হয়েছে ব্যক্তিগত রেন্টাল ব্যবসার স্থানে। নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের জন্য রাষ্ট্রের উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত গুটিকয়েক বিশেষ সুবিধাভোগীর অর্থনৈতিক লাভে পরিণত হয়েছে। প্রশাসনিক উদাসীনতা, বরাদ্দে স্বজনপ্রীতি এবং পর্যটনবাজারের প্রলোভন মিলিয়ে প্রকল্পটি এখন আবাসন নীতির ব্যর্থতার এক বাস্তব উদাহরণ।
যতক্ষণ পর্যন্ত এই ধরনের প্রকল্পে প্রকৃত লক্ষ্যগোষ্ঠীকে প্রাধান্য না দেওয়া হবে এবং বরাদ্দের স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সরকারি আবাসন অর্থনৈতিকভাবে টেকসই হলেও সামাজিকভাবে অকার্যকরই থেকে যাবে।

