ভোলার কালীনাথ রায়ের বাজারে অবস্থিত অগ্রণী ব্যাংক পিএলসি শাখায় কৃষিঋণ বিতরণ নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। একাধিক সূত্র জানায়, শাখার ব্যবস্থাপক ও সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তা কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে নিয়ম ও সক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে ঋণ বিতরণ করছেন।
একই এনআইডিতে একাধিক ঋণ
অভিযোগ রয়েছে—একই ব্যক্তিকে একাধিকবার ঋণ দেওয়া হচ্ছে, এমনকি একই জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে একাধিক ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। প্রতিটি ঋণ প্রদানে ১০ শতাংশ কমিশন নেওয়া এখন যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রেও অনিয়ম ও জালিয়াতির প্রমাণ মিলেছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুসন্ধানেও এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।
শাখাটির মোট আমানত ১৫ কোটি টাকা। নিয়ম অনুযায়ী, এর সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১২ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ বিতরণের অনুমতি রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ওই শাখা বিতরণ করেছে ৫২ কোটি টাকারও বেশি ঋণ, যা আমানতের প্রায় ৩৫৭ শতাংশ। এই অস্বাভাবিক ঋণ বিতরণ নিয়ে স্থানীয় কৃষক ও ভুক্তভোগীরা পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
দালালদের মাধ্যমে ‘ঋণ ব্যবসা’
সূত্র জানায়, পুরোনো ঋণ আদায় না করেই প্রতি সপ্তাহে ইউনিয়নভিত্তিক দালালদের মাধ্যমে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা নতুন ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এতে যুক্ত রয়েছেন ভেদুরিয়ার সিদ্দিকুর রহমান, পাতা ভেদুরিয়ার ইউসুফ, চরকালির জাহানারা বেগমসহ কয়েকজন বহিরাগত এজেন্ট।
অভিযোগ আছে, যাচাই-বাছাই, মাঠ পরিদর্শন বা আনুষ্ঠানিক অনুমোদন ছাড়াই ‘ম্যানুয়াল তালিকা’ ধরে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি ঋণ থেকে গড়ে পাঁচ হাজার টাকা কমিশন কাটা হয়—এর মধ্যে তিন হাজার যায় শাখা ব্যবস্থাপকের কাছে, এক হাজার জোনাল অফিসে পাঠানো হয় এবং বাকিটা দালালদের হাতে যায়।
ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ছিদ্দিকুর রহমান, ইউসুফ, জাহানারা বেগম, মিজানুর রহমান, সুমী নন্দী ও আব্দুল মালেক কবিরাজ নামে কয়েকজন ব্যক্তি ‘ফিল্ড রিপ্রেজেন্টেটিভ’ হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু তারা কেউই অগ্রণী ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক কর্মচারী নন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব দালাল কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে ব্যাংকের বাইরে লেনদেন করছেন। ফলে প্রকৃত কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছেন, আর লাভবান হচ্ছেন কেবল মধ্যস্বত্বভোগীরা।
অকৃষকদেরও কৃষিঋণ
অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত কৃষক নয়, এমন ব্যক্তিদেরও কৃষিঋণ দেওয়া হচ্ছে। যেমন—২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে ভোলা পৌরসভার পৌরনবীপুর এলাকার রিপনচন্দ্র মজুমদার পেয়েছেন ৪৫ হাজার টাকা কৃষিঋণ। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে তিনখাম্বা এলাকার সেলিনা বেগম ও আবদুর রহিম শিকদার যথাক্রমে ৬৮ হাজার ও ৫৮ হাজার টাকা ঋণ পেয়েছেন। অথচ এদের কেউই কৃষক নন। এ ধরনের আরও অনেক উদাহরণ স্থানীয় সূত্রে পাওয়া গেছে।
অগ্রণী ব্যাংক ভোলা আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক গণেশ চন্দ্র দেবনাথ স্বাক্ষরিত বরাদ্দপত্র অনুযায়ী, কালীনাথ রায়ের বাজার শাখার কার্যক্রম সীমিত বাপ্তা, ভেদুরিয়া ও ভেলুমিয়া ইউনিয়নে। কিন্তু বাস্তবে ওই শাখা ভোলা পৌরসভাসহ অন্যান্য এলাকাতেও ঋণ বিতরণ করছে। এসব লেনদেনের একাধিক নথি এই প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে।
২০২৪ সালের ২৮ জুলাই ভোলা জোনাল অফিসের পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাপ্তা ইউনিয়নের ১৯টি কৃষিঋণ ফাইল নিখোঁজ। স্থানীয় অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ভেদুরিয়া ও বাপ্তা ইউনিয়নের মোট প্রায় ১৫০টি ফাইল হারিয়ে গেছে। অভিযোগ রয়েছে—দালালদের সহায়তায় অনিয়মের প্রমাণ লোপাট করতে এসব ফাইল সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
তিন বছর ধরে ‘কমিশন রাজত্ব’
তিন বছর ধরে শাখার ব্যবস্থাপক খায়রুল বাশার পাভেল এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি ১০ শতাংশ কমিশনের বিনিময়ে রাতারাতি সম্পদের মালিক হয়েছেন। জোনাল অফিসের সহকারী ব্যবস্থাপক গণেশ চন্দ্র দেবনাথকে ‘ম্যানেজ’ করে তিনি অবাধে দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছেন বলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
তারা আরও জানান, শুধু গত আগস্টেই ভেদুরিয়ায় ১০ লাখ ও বাপ্তায় ৯ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এসব ঋণ প্রক্রিয়ায় দালালদের ভূমিকা ছিল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।
অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে শাখা ব্যবস্থাপক খায়রুল বাশার পাভেল বলেন, “এ অভিযোগ পুরোনো। বাংলাদেশ ব্যাংক তখন তদন্ত করে ব্যবস্থা নিয়েছিল। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর কোনো অনিয়ম হয়নি।”
তিনি দাবি করেন, একই ব্যক্তির একাধিক ঋণ সংক্রান্ত অভিযোগ ‘বানোয়াট’। তবে গরিব কৃষকরা পুরোনো ঋণ পরিশোধে অক্ষম হলে, একই ঋণ পুনরায় চালু করা হয়।
অগ্রণী ব্যাংকের ভোলা আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী ব্যবস্থাপক গণেশ চন্দ্র দেবনাথ বলেন, “এ ধরনের অভিযোগ পাইনি। পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তিনি স্বীকার করেন, নির্ধারিত এলাকার বাইরে কৃষিঋণ বিতরণের সুযোগ নেই।
অতিরিক্ত ঋণ বিতরণ প্রসঙ্গে তিনি জানান, “আগের ঋণসহ মোট স্থিতি ৫২ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের টার্গেট পূরণ করতেই এটি করা হয়েছে।”
বরিশাল সার্কেলের জেনারেল ম্যানেজার জাহিদ ইকবাল বলেন, “কালীনাথ রায়ের বাজার শাখার ব্যবস্থাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”