ঢাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও আবাসিক প্রকল্পের মাধ্যমে আশিয়ান গ্রুপের বিরুদ্ধে জমি দখল, প্লট জালিয়াতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ পাহাড় ছুঁয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নজরুল ইসলাম ভূঁইয়ার নাম বহু অপকর্মে জড়িয়ে রয়েছে। গত বছরের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলার ঘটনায় তার বিরুদ্ধে ২৩টি হত্যা মামলা আছে। এছাড়া গুম, চাঁদাবাজি ও নানা ধরনের কুকর্মেও জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নজরুলের খেলাপি ঋণ হাজার কোটি টাকার ওপর। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণগ্রহীতাদের তথ্য সংরক্ষণকারী ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি)-এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে আশিয়ান গ্রুপের এমডি নজরুলের ৯৮২ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হিসেবে দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে আশিয়ান এডুকেশনের নামে ৬৪৬ কোটি টাকা।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নানা অনিয়ম ও জালিয়াতির কারণে আশিয়ান গ্রুপের কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু নজরুল এসব এড়িয়ে ফের জমি দখল, প্রতারণা, জালিয়াতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাজউক, বাংলাদেশ ব্যাংক, পুলিশ প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
স্থানীয়রা জানায়, খেলাপি ঋণ থাকা সত্ত্বেও নজরুল ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার প্রতিষ্ঠান আশিয়ান সিটির আগ্রাসনের হাত থেকে দক্ষিণখান মৌজার ভূমি মালিকরা রক্ষা পাননি। সন্ত্রাসী বাহিনী ব্যবহার করে জমি দখল, বসতবাড়ি উচ্ছেদ, চাঁদাবাজি, জাল দলিল, জোড় করে গেট নির্মাণ, রাস্তা তৈরিসহ নানা অপকর্ম চালানো হচ্ছে। এ কারণে তাকে ‘ভূমিখেকো’ বলে অভিহিত করেছেন এলাকাবাসী। তারা তার দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন।
আশিয়ান গ্রুপের ঋণখাতও বিশাল সমস্যা তৈরি করেছে। বিভিন্ন ব্যাংকের এমডিরা জানিয়েছেন, গ্রুপের সব ঋণ খেলাপি। এবি ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মিজানুর রহমান বলেন, “গ্রুপের সব ঋণের অবস্থাই খারাপ। পুরো ঋণই এখন খেলাপি। যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া পাচ্ছি না।”
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তদন্তে দেখা গেছে, আশিয়ান গ্রুপ আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিশেষ প্রভাব খাটিয়ে ছয়টি ব্যাংক থেকে বিপুল ঋণ নেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে গ্রুপের খেলাপি ঋণ মোট ৯৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে আসিয়ান এডুকেশনের নামে ঋণ ৬৪৬ কোটি টাকা। ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে রয়েছে:
- এবি ব্যাংক: ৪০৪.৬১ কোটি
- ট্রাস্ট ব্যাংক: ৯০.৯০ কোটি
- আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক: ২৩.২৬ কোটি
- প্রিমিয়ার ব্যাংক: ১০০ কোটি
- ইসলামী ব্যাংক: ৩৪৩ কোটি
- ইউনিয়ন ব্যাংক: ১৫ কোটি
- সোনালী ব্যাংক: ৫.৫০ কোটি
রাজউকের নোটিস অনুযায়ী, অনুমোদন ছাড়া আশিয়ান ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের ‘আশিয়ান সিটি’ প্রকল্পের সব বিজ্ঞাপন, বিক্রয় ও প্রচার কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। ঢাকার দক্ষিণখান মৌজায় প্রকল্পটি এখনও অনুমোদন পায়নি।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরেও প্রতিষ্ঠানটি বিস্তীর্ণ এলাকায় প্লট বিক্রি করছে। ২০০৪ সালের ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা এবং ২০১০ সালের রিয়েল এস্টেট আইন অনুযায়ী, অনুমোদন ছাড়া জমি বিক্রি বা বিজ্ঞাপন দিলে ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রকল্পে থাকা জমির তুলনায় মানুষের কাছে বিক্রি করা প্লট ১০ গুণ বেশি। প্রকল্পের ৩১৮০ কাঠা জমির বিপরীতে ৩২ হাজার কাঠা প্লট বিক্রি হয়েছে। আশিয়ান সিটি বিক্রি করে দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি সংগ্রহ করেছে।
ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ৭.৮৯২৫ একর সরকারি খাস জমি দখল করে প্লট বিক্রির অভিযোগে আশিয়ান গ্রুপের এমডি নজরুলের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করেছে। ২০২৪ সালের ১ এপ্রিল মামলা দায়ের করা হয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, নজরুলের সন্ত্রাসী বাহিনী তাদের বসতবাড়ি ভেঙে দখল করেছে। সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগী মনোয়ারা বেগম বলেন, “আমরা মৃত্যুর ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। শত শত মানুষের জমি দখল করা হয়েছে।”
প্রাণনাশের ভয়ে নাম প্রকাশ না করা এক স্থানীয় বাসিন্দা জানান, নজরুলের হাত লম্বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত। তার সন্ত্রাসী বাহিনীও রয়েছে, যার মধ্যে আব্বাস আলী, ওলীউল্লাহ, রাশেদুল, নুরুল্লাহ, ফাহিম, আনিস, জিহাদ, নুরুল, সাইফুল, জাহিদুল, মজিবর ও রিয়াজ উল্লেখযোগ্য।
নজরুলের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ২৩টি মামলা থাকলেও তিনি বিএনপি-ভিত্তিক রাজনৈতিক পুনর্বাসনের চেষ্টা করছেন। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সাবেক এমপি মেজর (অব.) কামরুল ইসলাম এবং বিএনপি নেতা আমিনুল হকের পৃষ্ঠপোষকতায় নজরুল এলাকায় প্রভাব বিস্তার করছেন। তবে আমিনুল হক জানিয়েছেন, নজরুলের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, রাজউকের নোটিস পাননি। সুপ্রিম কোর্টও তার পক্ষে রায় দিয়েছে। এছাড়া তিনি জানান, বিভিন্ন ব্যাংকে তার ঋণ আছে কিন্তু খেলাপি নয়। দুদকের মামলাটিও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।