চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর উড়ালসড়কের স্টিল গার্ডার থেকে নাটবল্টু চুরি হয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের এক তদন্তে এই চুরির বিষয়টি উদ্ঘাটিত হয়েছে। ফলে নগরের অন্যতম ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ এই উড়ালসড়কের কাঠামোগত নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। তদন্তে জানা গেছে, ভাসমান মাদকসেবীরাই এসব চুরির সঙ্গে জড়িত।
মুরাদপুর উড়ালসড়কে রয়েছে তিনটি র্যাম্প (গাড়ি ওঠা-নামার পথ) এবং একটি লুপ (অন্য সড়কে সংযোগের বাঁকপথ)। মূল উড়ালসড়কটি নগরের শুলকবহর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত বিস্তৃত। এর মধ্যে বায়েজিদ বোস্তামী সড়ক থেকে জিইসি পর্যন্ত একটি র্যাম্প ও লুপ নির্মিত হয়েছে।
জিইসি থেকে বায়েজিদমুখী র্যাম্পের স্টিল গার্ডার থেকে নাটবল্টুসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ চুরির অভিযোগ ওঠে। এই অভিযোগের তদন্তে আগস্ট মাসে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে, যাতে সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রকৌশলীরা ছিলেন। সম্প্রতি তারা প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ৬৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে লালখান বাজার থেকে মুরাদপুর পর্যন্ত আখতারুজ্জামান চৌধুরী উড়ালসড়কের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। ২০১৯ সালে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিডিএ এটি সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে।
তদন্ত কমিটির সদস্যরা পরিদর্শনে গিয়ে দেখেন, জিইসি থেকে বায়েজিদ সড়কমুখী র্যাম্পের বিভিন্ন অংশে স্টিল গার্ডারের নাটবল্টু নেই। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এই অংশে ১৪০টি নাটবল্টু ও ৫৩টি ওয়াশার অনুপস্থিত। কমিটি বলেছে, মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মাধ্যমে এই চুরি সংঘটিত হওয়া অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, উড়ালসড়কের উচ্চতা ও কাঠামোগত জটিলতার কারণে পরীক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দক্ষ শ্রমিক এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি (যেমন ক্রেন ও ম্যান-লিফট) প্রয়োজন। কিন্তু সিটি করপোরেশনের কাছে এসব সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষিত জনবল না থাকায় নিয়মিত পরিদর্শন (রুটিন ইনস্পেকশন) কখনো হয়নি। তাই এই অবকাঠামোর নিরাপত্তা রক্ষায় রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাকে জরুরি ভিত্তিতে আধুনিকায়নের সুপারিশ করেছে কমিটি।
কমিটি বলেছে, উড়ালসড়কের কাঠামো রক্ষায় কারিগরি দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে এবং ৪০ থেকে ৭০ ফুট উচ্চতার ক্রেন লিফট কেনা প্রয়োজন। হঠাৎ নাটবল্টু সংযোজনের প্রয়োজন হতে পারে, তাই মজুত রাখার ব্যবস্থাও করতে হবে।
উড়ালসড়কের সুরক্ষায় কমিটির ১০ সুপারিশ-
তদন্ত প্রতিবেদনে উড়ালসড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ১০ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—
- নাটবল্টু চুরির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা
- আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভ্রাম্যমাণ দল দ্বারা নিয়মিত নজরদারি
- দক্ষ প্রতিষ্ঠান দিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে চুরি হওয়া নাটবল্টু পুনঃস্থাপন
- পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে কাঠামোগত সনদ গ্রহণ
- সকল উড়ালসড়কে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম চালু করা
- প্রয়োজনীয় সরঞ্জামসহ প্রশিক্ষিত টেকনিক্যাল জনবল নিয়োগ
- খোলা জায়গায় প্রবেশ ঠেকাতে কাঁটাতার স্থাপন
- উড়ালসড়কের নিচে সৌন্দর্যবর্ধনের পাশাপাশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
- উড়ালসড়কের ওপর ও নিচে সিসি ক্যামেরা বসিয়ে নজরদারি
- মাদকসেবীদের আস্তানা ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নিয়মিত অভিযান
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ জানিয়েছে, চুরি হওয়া স্থানে ইতিমধ্যে নতুন নাটবল্টু স্থাপন এবং কাঁটাতার বসানো হয়েছে, তবে বেশ কয়েকটি সুপারিশ এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
তদন্ত কমিটির সদস্যসচিব ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ রিফাতুল করিম চৌধুরী বলেন, “উড়ালসড়কের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা থেকে নাটবল্টু চুরি হওয়া উদ্বেগের বিষয়। গার্ডারের উচ্চতা বিবেচনায় এটি অস্বাভাবিক।
তবে আমাদের তদন্তে ভাসমান মাদকসেবীদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রভাব না পড়লেও দীর্ঘমেয়াদে এটি কাঠামোগত ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। তাই আমরা নিরাপত্তা জোরদারে একাধিক সুপারিশ দিয়েছি।”