ঢাকা মেট্রোরেলে অভিনব কৌশলে চলছিল ভাড়া জালিয়াতি। একটি সংঘবদ্ধ চক্রের কারণে লক্ষ লক্ষ টাকা ক্ষতির মুখে পড়ার পর কর্তৃপক্ষের টনক নড়েছে, কিন্তু জালিয়াতি বন্ধ করতে গিয়ে ‘একই স্টেশনে বিনা ভাড়ায় প্রবেশ ও বের হওয়ার’ সুবিধাও বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। তারা প্রশ্ন করছেন, “একটি চক্রের অন্যায়ের শাস্তি কেন আমাদের সবাইকে দিতে হবে?”
মেট্রোরেল পরিচালনাকারী ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সূত্রে জানা যায়, এমআরটি পাস বা র্যাপিড পাস কার্ড ব্যবহার করে একটি সংঘবদ্ধ চক্র দীর্ঘদিন ধরে বিনা ভাড়ায় এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে যাতায়াত করছিল। বিষয়টি ধরা পড়ার পরই গত সোমবার থেকে ‘বিনা ভাড়ায় এন্ট্রি-এক্সিট’ সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। তবে এই সুবিধা বন্ধ করায় বিপাকে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। তারা বলছেন, “মাথা ব্যথা হলে তার ব্যবস্থা নিতে হবে কিন্তু মাথা কেটে সমস্যার সমাধান হয় না।”

ঢাকার মেট্রোরেলে অভিনব ভাড়া জালিয়াতি, ১০টিরও বেশি ঘটনা ধরা পড়েছে:
ঢাকার মেট্রোরেলে অভিনব কৌশলে চলছিল ভাড়া জালিয়াতি। একটি সংঘবদ্ধ চক্র প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছিল। ডিএমটিসিএল ১০টিরও বেশি ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে, কারণ প্রতিদিন আড়াই লাখেরও বেশি যাত্রী মেট্রোরেল ব্যবহার করেন।
ডিএমটিসিএলের একাধিক কর্মকর্তা জানান, চক্রের সদস্যরা দুটি দলে ভাগ হতো—এক দল থাকত ট্রেন ছাড়ার স্টেশনে, অন্য দল গন্তব্যে। শুরুর স্টেশনে একজন কার্ড পাঞ্চ করে প্ল্যাটফর্মে ঢুকতেন। এরপর তিনি কার্ডটি স্টেশনের ভিতরে থাকা সঙ্গীকে দিতেন, যিনি সঙ্গে সঙ্গে কার্ড পাঞ্চ করে বেরিয়ে যেতেন। ফলে সিস্টেমে দেখাতো যাত্রী একই স্টেশন থেকে ঢুকেছে ও বের হয়েছে অর্থাৎ, কার্ড ছাড়া প্রথম যাত্রী ট্রেনে চড়ে নিজের গন্তব্যে পৌঁছাতেন, এবং সেখানে থাকা চক্রের অন্য সদস্যরা তাকে স্টেশন থেকে বের হতে সাহায্য করত। এভাবে প্রতিদিন অসংখ্যবার বিনা ভাড়ায় ভ্রমণ করা হতো।

এক কর্মকর্তা জানান, “আমরা লক্ষ্য করেছি কিছু যাত্রী একাধিকবার একই স্টেশনে ঢুকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে বের হচ্ছে। কার্ডের ডেটা ঘেঁটে দেখা যায়, একই কার্ডে একই স্টেশনে পুনরায় যাতায়াতের রেকর্ড। এতে বোঝা যায় কার্ডটি বিনা পয়সায় ব্যবহার করা হচ্ছে।” অন্য কর্মকর্তা বলেন, “অনেক অসাধু যাত্রী এন্ট্রি গেইটে কার্ড টাচ করে পাশে থাকা এক্সিট গেইটেও টাচ করেন। প্রকৃতপক্ষে তারা স্টেশনের পেইড জোন ত্যাগ করেন না। পরে ট্রেনে উঠে গন্তব্য স্টেশনে পৌঁছে সিকিউরিটি গার্ডকে বলেন—‘ভাই, কার্ড মনে হয় পাঞ্চ হয়নি, একটু পাঞ্চ দিয়ে দেন’। এরপর তারা অন্য দিকে এক্সিট করে। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে তারা সুকৌশলে ভাড়া ফাঁকি দিচ্ছিল।”
ঢাকার মেট্রোরেলে ফ্রি এন্ট্রি-এক্সিট বন্ধ, যাত্রীদের মধ্যে ভোগান্তি:
ঢাকার মেট্রোরেলে ‘ফ্রি এন্ট্রি-এক্সিট’ সুবিধা বন্ধ করা হয়েছে। সম্প্রতি ডিএমটিসিএলের নোটিশে জানানো হয়েছে, এখন থেকে একই স্টেশনে ঢুকে বের হলে ১০০ টাকা কর্তন হবে। এই নতুন নিয়ম ২০ অক্টোবর বিকেল থেকে কার্যকর হয়েছে। আগে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের নিয়ম ছিল, কেউ যদি ভুলবশত বা প্রয়োজনে কার্ড স্ক্যান করে ১৫ মিনিটের মধ্যে স্টেশন ত্যাগ করেন, তাকে কোনো ভাড়া দিতে হতো না। এটি ছিল যাত্রীবান্ধব একটি সুবিধা কিন্তু একটি সংঘবদ্ধ চক্র এই নিয়মের অপব্যবহার করায় ডিএমটিসিএল নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কিছু যাত্রী একাধিকবার একই স্টেশনে ঢুকে মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে যাচ্ছেন। কার্ডের ডেটা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একই কার্ডে একই স্টেশনে পুনরায় যাতায়াতের রেকর্ড। এতে বোঝা যায় কার্ডটি বিনা পয়সায় ভ্রমণের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। নতুন নিয়মের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকার ক্ষতি এড়ানো হবে বলে দাবি কর্তৃপক্ষের।
তবে নতুন নিয়মে যাত্রীরা চরম ভোগান্তির মুখে পড়েছেন। মেট্রোরেলের বিভিন্ন সেবায় নিয়োজিত একাধিক কর্মীও এই পরিবর্তনের পূর্বনির্ধারণের খবর পাননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বলেন, “গতকাল ডিউটির সময় হঠাৎ লক্ষ্য করা যায় যে কার্ড স্ক্যান করা হলেও এক্সিট প্রক্রিয়া কাজ করছে না। অফিসিয়ালি কোনো পূর্ব ঘোষণা না থাকায় বিষয়টি আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল।” তিনি আরও জানান, “নিয়মের এই অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনের ফলে অপারেশনাল কার্যক্রমে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে। যাত্রীরা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। সমস্যা এখনও কিছু স্থানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমরা পরবর্তী নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করছি।”
মেট্রোরেলের নতুন ফ্রি এন্ট্রি-এক্সিট নিয়মে যাত্রীদের ক্ষোভ:
ঢাকার মেট্রোরেলে নতুন ফ্রি এন্ট্রি-এক্সিট নিয়ম চালু হওয়ার পর অনেক যাত্রীর মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এখন থেকে কেউ একই স্টেশনে ঢুকে বের হলে ১০০ টাকা কর্তন হবে। সাধারণ যাত্রীদের প্রশ্ন, কার্ড স্ক্যানে ভুল বা আকস্মিক প্রয়োজনে কি সাধারণ মানুষকে এই জরিমানা দিতে হবে?
নিয়মিত যাত্রী আমিনুল ইসলাম জানান, “আগে ২০ টাকায় জরুরি প্রয়োজনে স্টেশনে ঢুকতে পারতাম। এখন হঠাৎ ১০০ টাকা কাটা হবে। এটা অন্যায় এবং সাধারণ মানুষের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে। সার্বজনীন জরিমানা না করে কেবল অপব্যবহারকারী চক্রকে লক্ষ্য করে পদক্ষেপ করা উচিত।”

একইভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মারুফা আকতার লিখেছেন, “ভাই, পাঁচ মিনিটের মধ্যে ব্লক করা ঠিক নয়। একজন বয়স্ক যাত্রী ভুল করে অন্য প্ল্যাটফর্মে নামলে তখন কি হবে? সিদ্ধান্তটি কাদের জন্য এবং কাদের ওপর প্রভাব ফেলছে, তা ভেবে দেখতে হবে। যাত্রীদের ওপর একেবারে জরিমানা চাপানো ঠিক নয়।” ডিএমটিসিএলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “আমরা মানুষের সুবিধা দিতে চাই কিন্তু যখন কেউ সেটার অপব্যবহার করে, তখন আমাদেরও পদক্ষেপ নিতে হয়। দুই নম্বরি কাজ করে কেউ চিটিং করছে, যার কারণে লাখ লাখ টাকার ক্ষতি হচ্ছে।” ইমরান খান নামের একজন লিখেছেন, “চুরি-ছিনতাই করে মেট্রো পাস দিয়ে কেউ নিজের এলাকায় নেমে পালাচ্ছে। কিছুটা অসুবিধা হলেও নতুন নিয়ম যাত্রীদের সুবিধা দিবে।” নতুন নিয়মের কারণে যাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়লেও মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের যুক্তি, এটি অব্যাহত অপব্যবহার ঠেকাতে এবং রাজস্ব ক্ষতি রোধ করতে নেওয়া হয়েছে।
ঢাকার মেট্রোরেলের ফ্রি এন্ট্রি-এক্সিট বন্ধের নতুন সিদ্ধান্তে একটি সংঘবদ্ধ চক্রের অপব্যবহার সীমিত হলেও সাধারণ যাত্রীদের অসুবিধা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সার্বজনীন জরিমানা না করে লক্ষ্যভিত্তিক পদক্ষেপ নিলে সমস্যা সমাধান আরও কার্যকর হতো। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের যুক্তি, এই নিয়ম রাজস্ব ফাঁকি রোধ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য জরুরি। তবে বাস্তবে তা যাত্রীসুবিধা ও অপারেশনাল কার্যক্রমে প্রভাব ফেলেছে। এই বিষয়টি সমাধানের জন্য দরকার স্থিতিশীল নীতি, পর্যাপ্ত নজরদারি এবং প্রযুক্তির ব্যবহার, যাতে অপব্যবহারকারীদের শাস্তি নিশ্চিত হয় এবং সাধারণ যাত্রীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ না পড়ে।

