ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) যেন এক সময় দুর্নীতির ‘সোনার খনি’তে পরিণত হয়েছিল। কাজ না করেই বিল পরিশোধ, ভুয়া দরপত্র, ঠিকাদারি আঁতাত, মানহীন নির্মাণ— এমন নানা অনিয়মে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সবই ঘটেছে তৎকালীন মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের সময়, যিনি ‘সবুজ সংকেত’ দিয়েছিলেন বলেই এই সিন্ডিকেট এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল বলে অভিযোগ ডিএসসিসির ভেতরের একাধিক সূত্রের।
দুদক ইতোমধ্যে ডিএসসিসিকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে দুর্নীতির সব নথি ও তথ্য চেয়েছে। অভিযোগ অনুযায়ী, মাত্র আটটি প্রকল্পেই প্রায় ৫৭৭ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে।
সড়ক উন্নয়নের নামে ১৫৪ কোটি টাকার ‘গায়েবি কাজ’
দুদকের অনুসন্ধানে সবচেয়ে বড় অনিয়ম ধরা পড়েছে শ্যামপুর, দনিয়া, মাতুয়াইল ও সারুলিয়া এলাকার সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে। ৭৩৬ কোটি টাকার এই প্রকল্পে অন্তত ১৫৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। নিম্নমানের কাজ, জাল বিল, প্রতারণা— সব মিলিয়ে প্রকল্পটি দুর্নীতির প্রতীক হয়ে উঠেছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ তদন্ত কমিটি গঠন করলেও, রহস্যজনক কারণে প্রতিবেদন আজও জমা পড়েনি। এই কাজের মূল দায়িত্বে ছিলেন সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. বোরহান উদ্দিন ও নির্বাহী প্রকৌশলী মিথুন চন্দ্র শীল।
ইউরোপ নয়, চীনের যন্ত্রে ৭৪ কোটি টাকার জবাইখানা
ইউরোপ থেকে আমদানির কথা বলে হাজারীবাগ ও কাপ্তানবাজার জবাইখানার আধুনিকায়নে খরচ করা হয় ৭৪ কোটি টাকা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্যবহার করা হয় নিম্নমানের চীনা যন্ত্রপাতি, যা কয়েক বছরের মধ্যেই অকেজো হয়ে পড়ে। বর্তমানে দুটি জবাইখানাই অচল। প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আনিছুর রহমান, নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম, মাহবুব আলম ও খায়রুল বাকের।
ল্যান্ডফিল প্রকল্পে ৫ কোটি টাকার ভুয়া বিল
মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলের সীমানা প্রাচীর নির্মাণে ৫ কোটি ১ লাখ টাকা কাজ না করেই বিল পরিশোধ করা হয়। পরে যা সামান্য অংশ নির্মিত হয়েছিল, সেটিও ভেঙে পড়ে। ঠিকাদারের কাছ থেকে টাকা ফেরতের নির্দেশ থাকলেও তা কখনো ডিএসসিসির তহবিলে জমা হয়নি।
খেলার মাঠে দুর্নীতি, বরখাস্তের পরও চাকরিতে ফেরা
মেন্দিপুর আল হেলাল ক্লাবসংলগ্ন মাঠের উন্নয়ন কাজে ১ কোটি ৭৪ লাখ টাকার দুর্নীতি ধরা পড়ে। নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও, পরবর্তীতে রহস্যজনকভাবে সেই আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। এতে সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী কাজী বোরহান উদ্দিনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
মহাপরিকল্পনায় আড়াই কোটি টাকার ‘ভূতুড়ে’ পেমেন্ট
ডিএসসিসির ১৮টি নতুন ওয়ার্ড এবং পুরো এলাকার জন্য মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে দুই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়। প্রতিবেদন অনুমোদন হওয়ার আগেই তাদের ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই প্রতিবেদন কমিশনই বাতিল করে দেয়— আর অর্থ ফেরত আনা হয়নি।
রেল সংযোগ প্রকল্পে ৫১ কোটি টাকা ‘উধাও’
পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ সংক্রান্ত কাজে রেলওয়ের কাছ থেকে ডিএসসিসি নেয় ৫১ কোটি ৪ লাখ টাকা। কিন্তু প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কোনো কাজই করা হয়নি। পরবর্তীতে রেলওয়ে বাকি ২২ কোটি টাকার অর্থ আটকে দেয়। এই প্রকল্পের অডিট আপত্তি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
শিশুপার্ক উন্নয়নে অতিমূল্যায়ন ও নাম বদলের কেলেঙ্কারি
শাহবাগের শিশুপার্ক সংস্কারে ২০০ কোটি টাকায় কাজ সম্ভব হলেও, সেটির প্রাক্কলন করা হয় ৪৫০ কোটি টাকা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও মেয়র তাপসের ঘনিষ্ঠ কাউন্সিলরদের আঁতাতে কাজটি আগেই নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়। এমনকি শহীদ জিয়া শিশুপার্কের নামও পরিবর্তন করা হয়, যা পরে গণ-অভ্যুত্থানের পর ফের পুরনো নামে ফিরিয়ে আনা হয়।
ট্রাফিক সিগন্যাল প্রকল্পেও ‘অদৃশ্য ব্যয়’
ডিএসসিসি এলাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়কে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ও নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপনে ৩৮ কোটি টাকা খরচ দেখানো হলেও বাস্তবে কিছুই হয়নি। যেখানে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ হওয়ার কথা ছিল, সেখানে বর্তমানে আনসার সদস্যরা অবস্থান করছেন।
দুদকের একজন কর্মকর্তা জানান,
“ডিএসসিসির দুর্নীতির সব দিকই এখন তদন্তাধীন। প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ডিএসসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম বলেছেন,
“দুদক যেসব তথ্য চেয়েছে, সেগুলো সরবরাহ করা হচ্ছে। যদি কেউ অনিয়মে জড়িত থাকে, তাকে ছাড় দেওয়া হবে না।”
তবে সিটি করপোরেশনের ভেতরকার অনেকেই বিশ্বাস করেন, মেয়র তাপসের ‘সবুজ সংকেত’ ছাড়া এত বড় অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ সম্ভব ছিল না। তারা বলছেন, যদি দুদক নিরপেক্ষভাবে অনুসন্ধান চালায়, তাহলে পুরো সিন্ডিকেটের নাম প্রকাশ্যে আসবে— আর তাতে বেরিয়ে আসবে ডিএসসিসির দুর্নীতির আসল চিত্র।
একটি শহরের উন্নয়ন প্রকল্পের আড়ালে গড়ে ওঠা দুর্নীতির সাম্রাজ্য এখন দুদকের টেবিলে। সত্যটা বেরিয়ে আসতে হয়তো সময় লাগবে, কিন্তু লক্ষ কোটি টাকার এই কেলেঙ্কারি ঢাকায় সুশাসনের মুখে যে গভীর প্রশ্ন তুলেছে— তা আর অস্বীকার করার উপায় নেই।

