বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সচিব মোহাম্মদ কামাল হোসেন সিকদার। তিনি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে গত ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত কক্সবাজার নারী ও শিশু দমন ট্রাইবুন্যালের বিচারক ছিলেন। সে সময়ে তার আদালতের স্টেনোগ্রাফার ছিলেন মো. সেলিম। আর এ পরিচয় পুঁজি করেই এবারের বার কাউন্সিলের ফল প্রত্যাশিতদের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সেলিমের বিরুদ্ধে। এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে সেলিমের এমন কথোপকথনের একটি রেকর্ড সূত্রের প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে।
সেখানে সেলিমকে বলতে শোনা যায় ‘সচিবের জন্য নগদ ৩ লাখ টাকা লাগবে, আমার জন্য ৫০ হাজার। কাজটা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।’
তিনি আরো বলেন, ‘স্যার, রোল নাম্বারগুলো ফলাফল সিটে উঠিয়ে দেবেন। এ ছাড়া আরও যা যা করতে হয়, তা করবেন। তা স্যারের জন্য কোনো ব্যাপারই না।’
কিন্তু অভিযুক্ত স্টেনোগ্রাফার মো. সেলিম তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, কথোপকথনের কোনো রেকর্ড কেউ দেখাতে পারবে না। এখন রেকর্ড এআই দিয়ে করা যায়।
দিন দিন আইন পেশার প্রতি শিক্ষার্থীদের ঝোঁক বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। বেশ কিছু পাবলিক বিশবিদ্যালয়, জাতীয় বিশবিদ্যালয়সহ বেসরকারি অনেক বিশবিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর বহুসংখ্যক শিক্ষার্থী আইনে ডিগ্রি নিয়ে আইনজীবী হতে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের পরীক্ষায় বসেন। প্রতি বছরের নির্দিষ্ট সময়ে অন্তত ৪০ থেকে ৫০ হাজার শিক্ষার্থী বার কাউন্সিলের এমসিকিউ পরীক্ষায় অংশ নেন। এই ধাপ শেষে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হন, তারা বার কাউন্সিলের সনদ পান এবং নিবন্ধিত হিসেবে আইন পেশায় অংশ নিতে পারেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এ পরীক্ষা কেন্দ্র করে একশ্রেণির প্রতারক পাস করিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করেন বলে প্রায়ই অভিযোগ ওঠে।
জানা গেছে, আগামী সপ্তাহের যেকোনো দিন বার কাউন্সিলের লিখিত পরীক্ষায় ফল ঘোষণা করা হবে। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সেলিম কক্সবাজার জেলার প্রায় ৩০ জন ফল প্রত্যাশিতদের কাছ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করে ১ কোটি ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলেন অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে ফলপ্রত্যাশী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘সেলিম শুধু কক্সবাজার বার থেকে নয়, দেশের বিভিন্ন বারের পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। শতভাগ পাসের নিশ্চয়তা দিয়ে তিনি প্রত্যেকজনের কাছ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করে নেন।’
এদিকে সেলিম নিজেকে সচিবের কাছের মানুষ প্রমাণ করতে তার সঙ্গে সচিবের হোয়াটসঅ্যাপ কথোপকথন ও মেসেজ আদান প্রদানের বিষয়টি ফল প্রত্যাশিতদের দেখান। ফল প্রত্যাশিতদের কাছে সেলিম দাবি করেন, তিনি বিভিন্ন সময় বার কাউন্সিলের সচিবকে মাছ, আচারসহ নানা সামগ্রী পাঠান।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কক্সবাজারের টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘সেলিম আমাকে সচিবের সঙ্গে তার কথোপকথনের প্রমাণ দেখিয়েছেন। নানা সময় সচিবকে বিভিন্ন জিনিস পাঠানোর ছবিও দেখিয়েছেন হোয়াটসঅ্যাপে।’
ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী সজীব বালা বলেন, ‘এমসিকিউ থেকে একটি চক্র পরীক্ষার্থীদের পাস করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। অ্যাটর্নি জেনারেলও ৩০০ পরীক্ষার্থীকে পাস করানোর সুপারিশ আসে বলে লাইভে বলেছিলেন। তিনি ছাড়া অন্যরা সুপারিশ মেনেও নিয়েছিলেন। কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেল মেনে না নেওয়ায় তা হয়নি। তখন থেকে একটি চক্র অপচেষ্টা করে যাচ্ছে।’
বর্তমানে বিভিন্ন এজেন্ট যে টাকার বিনিময়ে পাসের চুক্তি করেছে, এটা সবাই জানেন। তিনি বলেন, ‘পরীক্ষার্থীরা লিখিত খাতা রিভিউর সুযোগ পেলে অন্য কেউ অন্যায়ের সুযোগ নিতে পারত না। কিন্তু এ ব্যাপারে কারও মাথাব্যথা নেই।’
তিনি আরো বলেন, ‘কক্সবাজারের এক সময়ে কর্মরত এক জজের নাম ভাঙিয়ে সেখানকার স্টেনোগ্রাফার লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এটি এখন আইনজীবীদের কাছে ওপেন সিক্রেট।’
অন্য আইনজীবী মো. শামসুদ্দোহা বলেন, ‘যে তথ্যগুলো বিভিন্ন মাধ্যমে শোনা যাচ্ছে, যা নিঃসন্দেহে হতাশাজনক বার কাউন্সিলের পরীক্ষার্থীদের জন্য। বার কাউন্সিল কর্তৃপক্ষের উচিত তা সঠিকভাবে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।’
তবে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সচিব মোহাম্মদ কামাল হোসেন সিকদার বলেন, ‘আমি মাত্র এক সপ্তাহ কক্সবাজার ছিলাম। কাজেই ওখানকার কারও সঙ্গে আমার বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই। কেউ যদি আমার নাম ব্যবহার করে তার বিরুদ্ধে আমি আইনি ব্যবস্থা নেব।’
তিনি আরো বলেন, ‘পরীক্ষার ফল দ্রুত ঘোষণা করা হবে। ওখানে যদি কেউ পাস করে থাকে সেটা তার যোগ্যতাবলেই করবে। এখানে টাকার বিনিময়ে পাসের কোনো সুযোগ নেই। কেউ যদি তাকে টাকা দিয়ে থাকে তবে সেই টাকা যেন এখনই ফিরিয়ে নেন এবং ভুক্তভোগী হিসেবে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে এটাই আমার চাওয়া।’
সচিব কামাল হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে কক্সবাজারে জেলা জজ নেই। শিগগিরই একজন জয়েন করবেন। আমি সেই জজকে অনুরোধ করব যেন সেলিমের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
সূত্র: দেশ রূপান্তর

