বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এখন ২৯ জন অবৈধ পরামর্শকের কারণে চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। না তাদের সরানো যাচ্ছে, না রাখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের দলীয় বিবেচনায় চাকরি বিধি উপেক্ষা করে নিয়োগ পাওয়া এসব কর্মকর্তাকে নিয়ে বিপাকে পড়েছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ (পিটিডি)। বারবার চিঠি পাঠিয়েও বিটিআরসি থেকে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ ১৬ অক্টোবরের ব্যাখ্যাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ ঘোষণা করেছে তারা।
২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে আওয়ামী সরকারের সময়ে বিটিআরসিতে ২৯ জন পরামর্শককে রাজস্ব খাতের বিভিন্ন পদে নিয়মবহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অডিট অধিদপ্তর, পিটিডি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তেও এসব নিয়োগে অনিয়মের প্রমাণ মেলে। তবুও অধিকাংশ কর্মকর্তা এখনো বহাল আছেন।
তদন্তে দেখা যায়, ১৫ জন প্রার্থীর বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত পূরণ করেনি। কেউ কেউ লিখিত পরীক্ষায় অংশ না নিয়েই চাকরি পেয়েছেন। এমনকি অনেকেই পদোন্নতি পেয়ে এখন উপপরিচালকের দায়িত্বে।
বিতর্কিত কর্মকর্তাদের তালিকা
বিটিআরসিতে বর্তমানে কর্মরত বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন উপপরিচালক খালিদ ফয়সাল রহমান, নাহিদুল হাসান, শারমিন সুলতানা, তাসমিয়া তাহমিদ, মিরাজুল ইসলাম, তৌহিদ হোসেন, এসএম তাইফুর রহমান, রোখসানা মেহজাবীন, রাইসুল ইসলাম, মো. আসাদুজ্জামান, তৌহিদুর নাহার, নাফিসা মল্লিক, মাহরীন আহসান, সামিরা তাবাসসুম, এসএম গোলাম সারোয়ার, মেহফুজ বিন খালেদ ও শামসুজ্জোহা।
এছাড়া সহকারী পরিচালক কাউছার আহমেদ, শামছুল আলম, উপসহকারী পরিচালক রেজাউল করিম, দেওয়ান মো. ফারুক আহমেদ ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলামও একইভাবে বয়স ও যোগ্যতার শর্ত ভঙ্গ করে নিয়োগ পান।
অডিটে অনিয়ম প্রমাণিত
অডিট প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘নির্দিষ্ট কাজ ও সময়ের জন্য’ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের নিয়ম থাকলেও বিটিআরসি এসব পরামর্শককে স্থায়ী রাজস্ব খাতে নিয়োগ দিয়েছে। শুধু মৌখিক সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে নিয়োগ দিয়ে তাদের ‘বিভাগীয় প্রার্থী’ হিসেবে দেখানো হয়েছে, যা বিধিবহির্ভূত।
পিটিডির সহকারী সচিব (নিরীক্ষা-২) লায়লা করিম স্বাক্ষরিত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, অভিযুক্ত ২৯ কর্মকর্তা অনুমোদিত কাঠামোর বাইরে ছিলেন। তাই তাদের বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে গণ্য করার সুযোগ নেই। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে দায় নির্ধারণ ও পুনরায় ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দিয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধান শুরু
অবৈধ নিয়োগ ও আর্থিক অনিয়মের ঘটনায় সাবেক চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর শিকদারসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থার সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নূর আলম সিদ্দিকীর নেতৃত্বে এই তদন্ত চলছে।
দুদক ২০১৬–২০২০ অর্থবছরের রাজস্ব আদায় ও মনিটরিং ব্যবস্থাপনার নিরীক্ষা প্রতিবেদনসহ নিয়োগ সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র চেয়েছে। এতে সাবেক কমিশনার ড. মুশফিক মান্নান চৌধুরী, পরিচালক এমএ তালেব হোসেন, উপপরিচালক খালেদ ফয়সাল রহমান ও শারমিন সুলতানার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।
দুদকের কর্মকর্তা নূর আলম সিদ্দিকী বলেন, “অভিযোগ যাচাই-বাছাই চলছে। কিছু নথি পেয়েছি, সেগুলো বিশ্লেষণ করে কাজ শুরু হয়েছে।”
অভিযুক্তদের প্রতিক্রিয়া
প্রাক্তন চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর শিকদার বলেন, “দুদক তদন্ত করছে জেনেছি। আমি তদন্তকে স্বাগত জানাই। তদন্ত হলে সত্য প্রকাশ পাবে।”
অভিযোগের বিষয়ে প্রশাসন বিভাগের পরিচালক এমএ তালেব হোসেন বলেন, “আমি কোনো অনিয়ম করিনি। সবকিছু নিয়ম মেনেই হয়েছে।”
উপপরিচালক খালেদ ফয়সাল রহমানের বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে, তিনি বয়স সংশোধন ও লিখিত পরীক্ষা ছাড়াই চাকরি পেয়েছেন। নিয়োগ বাণিজ্যেও তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ আছে। তবে তিনি মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
শারমিন সুলতানা সম্পর্কে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনি লিখিত পরীক্ষা ছাড়াই চাকরি পান, বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতায় অনিয়ম করেন এবং সরকারি অনুমোদন ছাড়াই বিদেশ ভ্রমণ করেন। এজন্য তাকে ওএসডি করা হয়েছে। তিনি বলেন, “আমি জানি না, আমার তথ্য কেন চাওয়া হয়েছে। বিষয়টি বিটিআরসি ও মন্ত্রণালয়ের।”
বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী বলেন, “দুদকের চিঠি পাওয়া স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আমরা নিয়ম অনুযায়ী তথ্য সরবরাহ করি। কমিশন সব সময় স্বচ্ছতা বজায় রাখতে চায়।”
রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক দুর্নীতি
অভিযোগ আছে, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সহায়তায় এসব নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর শিকদার অনিয়মিতভাবে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে প্রশাসনিক সিন্ডিকেটকে আরও শক্তিশালী করেন।
২০২৩ সালে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের দপ্তরের এক অডিটে এই অনিয়মের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হয়। তবুও কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং অভিযুক্তদের পদোন্নতি দেওয়া হয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “এটি প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয়ের স্পষ্ট উদাহরণ। ক্ষমতাচ্যুত সরকার রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে দুর্নীতির অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে।”

