বাংলাদেশে আমদানি-রপ্তানি, মুঠোফোনে আর্থিক সেবা (এমএফএস) ও মোবাইল মেরামতের ব্যবসার আড়ালে অবৈধ অর্থ লেনদেনের (হুন্ডি) সঙ্গে জড়িত মালয়েশিয়ার দুই ভাইয়ের নাম উঠে এসেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রতিবেদনে।
এই দুই ভাই হলেন সিরাজউদ্দিন বিন বদরুদ্দিন ও মোহসিন বিন বদরুদ্দিন। বিএফআইইউ জানিয়েছে, তাঁদের নামে বাংলাদেশে সাতটি এবং মালয়েশিয়ায় একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। মালয়েশিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশিদের বেতন তাঁরা সংগ্রহ করে এমএফএসের মাধ্যমে দেশে পাঠান, যা হুন্ডির এক রূপ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিএফআইইউর নথি অনুযায়ী, বাংলাদেশে তাঁদের প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—জেন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, এম এম সার্ভিস, সেলিগ্রা সার্ভিস লিমিটেড, কমপিউগেটস ইন্টারন্যাশনাল, ডেন্স রিটেইল লিমিটেড, আইডিই ডিজাইন লিমিটেড ও টেলিগ্রা লিমিটেড। এছাড়া তাঁদের নামে মুঠোফোন আর্থিক সেবাদাতা একটি প্রতিষ্ঠানের ডিস্ট্রিবিউটরশিপ লাইসেন্সও রয়েছে। রাজধানীর ধানমন্ডির এ আর প্লাজায় অবস্থিত জেন ইন্টারন্যাশনালের অফিস থেকেই এই ব্যবসা পরিচালিত হয়।
গত ৫ অক্টোবর প্রতিবেদনের অনুসন্ধান দল ধানমন্ডির জেন ইন্টারন্যাশনালের কার্যালয়ে গিয়ে কথা বলে প্রতিষ্ঠানের উপমহাব্যবস্থাপক (অব.) লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সাঈদ এম কাসেদের সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁদের প্রতিষ্ঠান কোনোভাবে হুন্ডিতে জড়িত নয়। কোনো এজেন্ট ব্যক্তিগতভাবে এমন কাজে যুক্ত থাকলে তার দায় প্রতিষ্ঠান নেবে না।
সাঈদ কাসেদের ভাষায়, বর্তমানে সিরাজউদ্দিন ও মোহসিনের তিনটি প্রতিষ্ঠান চালু আছে, বাকিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।
২০২৩ সালে বিএফআইইউর প্রতিবেদন পাওয়ার পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বিষয়টি অনুসন্ধান করেছিল। তবে তখন মামলা হয়নি। সিআইডির একটি সূত্র জানিয়েছে, তৎকালীন প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া প্রভাব খাটিয়ে তদন্ত ধামাচাপা দেন। বর্তমানে বিষয়টি পুনরায় অনুসন্ধানাধীন।
সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার লুৎফুল কবির জানিয়েছেন, মালয়েশীয় দুই ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচারের তদন্ত এখনো চলছে।
হুন্ডি চক্রের পদ্ধতি
বিএফআইইউর প্রতিবেদনে মালয়েশীয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা এফআইইউর তথ্য উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, সিরাজউদ্দিনের নামে মালয়েশিয়ার সিআইএমবি ব্যাংকে বিভিন্ন শাখা থেকে বিপুল অঙ্কের রিঙ্গিত জমা হয়েছে। এর মধ্যে এন এস এম ফারুক নামের এক বাংলাদেশির মাধ্যমে জমা হয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার রিঙ্গিত। ফারুকের নামে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে বাংলাদেশে ব্যবসা করেন সিরাজউদ্দিন ও মোহসিন। বর্তমানে ফারুক মালয়েশিয়ায় নিবন্ধিত একটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
ফারুক ছাড়াও মেহেদী হাসান ও ফায়েজ আলী নামের আরও দুই বাংলাদেশির মাধ্যমে সিরাজউদ্দিনের ব্যাংক হিসাবে বড় অঙ্কের টাকা জমা হয়েছে। ২০১৬ সালের ৩ মার্চ ও ২০১৯ সালের ৪ জুলাই তারিখে এই লেনদেন হয়। অর্থ জমার সময় ‘অনুদান ও উপহার’ হিসেবে দেখানো হয়। প্রবাসী বাংলাদেশিদের উপার্জিত এই অর্থ পরে দেশে এমএফএসের মাধ্যমে তাঁদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।
পড়তে এসে ব্যবসায়ী
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিরাজউদ্দিন প্রথমে চিকিৎসাবিদ্যা পড়ার জন্য বাংলাদেশে আসেন। পড়াশোনা শেষে তিনি আবদুল কাইউম তসলিম নামের এক বাংলাদেশির মাধ্যমে ২০১৩ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে আমদানি-রপ্তানি ও সরবরাহ ব্যবসার জন্য ট্রেড লাইসেন্স নেন। এরপর ধানমন্ডির এ আর প্লাজার ছয়তলায় জেন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানটি ২০১২ সালের ২২ এপ্রিল যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধক দপ্তর থেকে নিবন্ধন পায়। পরে এই প্রতিষ্ঠানের নামে দেশের ১৪টি অঞ্চলে এমএফএস ডিস্ট্রিবিউটরশিপ নিয়ে ব্যবসা শুরু হয়।
বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ডিস্ট্রিবিউটরশিপের আড়ালেই হুন্ডি লেনদেন পরিচালিত হতো। জেন ইন্টারন্যাশনালের অধীনে থাকা ১১৮ জন এজেন্ট হুন্ডির সঙ্গে জড়িত ছিল।
দুই ভাইয়ের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে ৪৩টি হিসাব খোলা হয় ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত। এসব হিসাবে প্রায় ২১ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে।
২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিস্ট্রিবিউটরদের হিসাবও বিএফআইইউ বিশ্লেষণ করে। দেখা যায়, ওই সময়ে রাত ১২টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত ১৫ হাজার টাকার বেশি অঙ্কের লেনদেন হয় প্রতি মিনিটে তিনবারেরও বেশি।
কর্মচারীদের নামে ট্রেড লাইসেন্স
বিএফআইইউর নথিতে দেখা গেছে, জেন ইন্টারন্যাশনালের ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া হয়েছিল কর্মচারী আবদুল কাইউম তসলিমের নামে। একইভাবে দুই ভাইয়ের মালিকানাধীন অন্য ছয়টি প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্সও সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের নামে নেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এসব প্রতিষ্ঠানের নামে রাখা সিকিউরিটি ডিপোজিটের কিছু অর্থ অবৈধ পথে বাংলাদেশে আনা হয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ বিভাগ ও বিনিয়োগ বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই জেন ইন্টারন্যাশনাল ক্যারিবীয় ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জে নিবন্ধিত একটি কাগুজে কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করছে।

