চট্টগ্রামের রাউজানে একের পর এক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে থামছে না রক্তপাত। কখনো প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে, কখনো ছুরিকাঘাতে বা পিটিয়ে খুন করা হচ্ছে মানুষ। কিন্তু এসব ঘটনার মূল আসামি বা অস্ত্রধারীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। উদ্ধার হয়নি ব্যবহৃত কোনো অস্ত্রও। স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশের গ্রেপ্তার অভিযান চললেও প্রকৃত অপরাধীরা অদৃশ্য রয়ে যাচ্ছে।
গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত রাউজানে মোট ১৭টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যার মধ্যে ১২টি সরাসরি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা। সর্বশেষ শনিবার (২৫ অক্টোবর) বিকেলে যুবদল কর্মী মুহাম্মদ আলমগীর আলমকে চারাবটতল এলাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর আগেও ৭ অক্টোবর হাটহাজারীর মদুনাঘাটে বিএনপি কর্মী মুহাম্মদ আবদুল হাকিমকে চলন্ত গাড়িতে গুলি করে খুন করে অস্ত্রধারীরা। এ দুই হত্যাকাণ্ডসহ কোনো ক্ষেত্রেই এখনো শনাক্ত হয়নি খুনের অস্ত্র বা প্রকৃত শুটাররা।
পুলিশ বলছে, এখন পর্যন্ত ১২টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মামলায় ১৪০ জন আসামি চিহ্নিত হয়েছে, যার মধ্যে ৬০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু নিহতদের পরিবার দাবি করছে, যারা প্রকাশ্যে গুলি চালিয়েছে কিংবা হত্যার নির্দেশ দিয়েছে, তারা কেউই গ্রেপ্তার হয়নি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রাউজানে রাজনৈতিক সহিংসতার মূল কারণ বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। দলটির দুই প্রভাবশালী নেতা—কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী (যার পদ স্থগিত আছে) এবং চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকারের অনুসারীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে আধিপত্যের লড়াই চলছে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর পক্ষদ্বয় একে অপরকে দায়ী করে আসছে।
এই সংঘাতের অন্যতম আলোচিত চরিত্র ‘সন্ত্রাসী’ রায়হান। তাঁর নাম ঘুরে ফিরে আসছে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডে। গত ৬ জুলাই কদলপুর ইউনিয়নের ইশানভট্ট হাটে বোরকা পরা একদল অস্ত্রধারী প্রকাশ্যে যুবদল নেতা মুহাম্মদ সেলিমকে গুলি করে হত্যা করে। ওই মামলার অন্যতম আসামি রায়হান। নিহতের বাবা আমির হোসেন বলেন, “অস্ত্রধারীরা প্রকাশ্যে গুলি করে চলে যায়, অথচ পুলিশ তাদের ধরতে পারে না।”
এ বছর ২২ এপ্রিল রাউজান সদর ইউনিয়নের গাজীপাড়ায় যুবদল কর্মী ইব্রাহিমকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই মামলাতেও রায়হানের নাম রয়েছে। সর্বশেষ আলমগীর আলম হত্যাকাণ্ডের পরও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে নিহত আলমগীরকে রায়হানের নাম উল্লেখ করে আতঙ্ক প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
রায়হানের বিরুদ্ধে গত বছরের আগস্টের পর থেকে চট্টগ্রাম নগর ও জেলায় ১৩টি মামলা হয়েছে, যার মধ্যে ছয়টি হত্যা মামলা। জানা গেছে, তিনি একসময় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের মিছিল ও সমাবেশে অংশ নিতেন, পরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে গেলে বিএনপির কর্মসূচিতে যোগ দিতে শুরু করেন।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম) মো. রাসেল বলেন, “পুলিশ বেশ কয়েকজনকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করেছে। বাকি আসামিদের ধরতে অভিযান চলছে। অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারের লড়াই থেকে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটছে, যা রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া রোধ করা কঠিন।”
নিহত আলমগীরের স্ত্রী লাভলী আক্তার বলেন, “আমার স্বামীকে যারা হত্যা করেছে, তাদের ফাঁসি চাই।”
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক বেলায়েত হোসেন বলেন, “যে বা যাঁরা জড়িত থাকুন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন ব্যবস্থা নেয়। যদি বিএনপির কারও সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, দল থেকেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”
রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া জানান, নিহত আলমগীরের ময়নাতদন্ত শেষে দাফন সম্পন্ন হয়েছে, মামলা নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “অস্ত্রধারীদের শনাক্ত করা গেছে, তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।”
ক্রমবর্ধমান এই সহিংসতার ঘটনায় রাউজানে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। স্থানীয়রা বলছেন, রাজনৈতিক আধিপত্যের লড়াইয়ে সাধারণ মানুষই পরিণত হচ্ছে রক্তপাতের বলি, আর প্রকৃত অপরাধীরা থেকে যাচ্ছে অদৃশ্য ছায়ার আড়ালে।

