ইউনিয়ন ব্যাংকে ২০২১-২২ অর্থবছরে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) ও বিনিয়োগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি হাবিবুর রহমানের নাম উঠে এসেছে বিতর্কিত ঋণ অনুমোদনে।
ইউনিয়ন ব্যাংকের ঋণপ্রস্তাবের অফিস নোটে তখন হাবিবুর রহমানের স্বাক্ষর দেখা গিয়েছে। নোটে লেখা ছিল, ‘প্রধান কার্যালয়ের প্রথম ও শেষ অনুমোদন।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক পরিদর্শন প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাবিবুর রহমান ইউনিয়ন ব্যাংকে ছিলেন এবং তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন এস আলম গ্রুপের পক্ষে ২৬০৭ কোটি টাকার অনিয়মিত ঋণ অনুমোদনে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ–৭ এর রিপোর্ট বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রিত প্রায় ৩০টি ‘নামসর্বস্ব’ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে পৃথকভাবে ২৩ কোটি টাকা থেকে ১৪৮ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ অনুমোদন করা হয়। এসব ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়ায় ২ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা। এখন ওই ঋণগুলো খেলাপি হয়ে গেছে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই অস্তিত্বহীন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে।
হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একাধিক মামলা রয়েছে। এক বিবরণে বলা হয়েছে, ২০০০ সালে তিনি মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ক্রেডিট বিভাগে থাকাকালে ‘প্যাট্রিক ফ্যাশনস’ নামের এক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ গোপন করে নতুনভাবে আট কোটি টাকার ঋণ অনুমোদনের জন্য মিথ্যা তথ্য দেয়ার অভিযোগ ওঠে। অভিযোগে তার বিরুদ্ধে প্রতারণা, যোগসাজশ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মামলা দায়ের করা হয় (মামলা নং ২৭২/২২)।
২০২৪ সালে ওই মামলায় চার্জশিট দাখিলের পর হাইকোর্ট (রিট নং ৫২১৭/২০২৪) বাংলাদেশ ব্যাংককে ৬০ দিনের মধ্যে হাবিবুর রহমান সম্পর্কে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়। এরপর তিনি স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে তিনি পুনরায় স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি হিসেবে দায়িত্বে ফিরে আসেন।
অভিযোগ আছে, হাবিবুর রহমান স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে ইউনিয়ন ব্যাংকের কয়েকজন বিতর্কিত কর্মকর্তা পুনর্নিয়োগ দিয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন বর্তমান মানবসম্পদ প্রধান মনসুর আহমেদ ও প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) মো. সালাহ উদ্দিন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে তাদের নামও এস আলম গ্রুপের অনুকূলে অনুমোদিত ঋণের তালিকায় আছে।
দুদক সম্প্রতি হাবিবুর, মনসুর ও সালাহ উদ্দিনকে ইউনিয়ন ব্যাংকের অর্থপাচার সংক্রান্ত তদন্তে তলব করেছে বলে জানা গেছে।
আইনগত ও নিয়োগ সংক্রান্ত নীতিভঙ্গের অভিযোগও রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি সার্কুলার নং ৩ ও ৪১ অনুযায়ী ব্যাংকের সিএফও পদে থাকা জরুরি শর্ত হলো চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হওয়া। বর্তমান সিএফও সালাহ উদ্দিন এই যোগ্যতা ছাড়া নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন—এটি সার্কুলার লঙ্ঘন।
একইভাবে প্রধান আইন কর্মকর্তা মো. আখতারুজ্জামানও সুপ্রিম কোর্টে তিন বছরের অভিজ্ঞতা ও বার কাউন্সিলের সদস্যপদ ছাড়া নিয়োগ পেয়েছেন। এটি নিয়োগনীতির সরাসরি লঙ্ঘন বলে অভিযোগ উঠেছে।
আরও একটি প্রাসঙ্গিক বিধান হল ২০২৪ সালের বিআরপিডি সার্কুলার নং ৫ [ধারা ২(ক)(৮)]। সে অনুযায়ী কোনো ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে যদি কারো বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য থাকে, সে ব্যক্তি কোনো ব্যাংকের এমডি বা সিইও হিসেবে নিযুক্ত হতে পারবেন না।
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি হাবিবুর রহমান বলেন, “আমি তখন ইউনিয়ন ব্যাংকের এএমডি। আমার ঋণ অনুমোদনের কোনো সুযোগ ছিল না। ঋণ অনুমোদন করেন ব্যাংকের এমডি ও পরিচালনা পর্ষদ। ওই সময় ব্যাংক থেকে টাকা লুট করতে কী ধরনের কৌশল নেওয়া হয়, তা সবাই ইতোমধ্যে জেনে গেছে। আমি কোনো অন্যায় করলে নিশ্চয়ই এতদিন একটি ব্যাংকের এমডি থাকতে পারতাম না।”
এখানে এখন প্রধান প্রশ্নগুলো হল—বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্টের ভিত্তিতে নেওয়া হবে কী ধরনের শাস্তিমূলক বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা। একই সঙ্গে তদন্তে উন্মোচিত তথ্যগুলো যদি সত্যি হয়, তাহলে আর্থিক নিয়মবিধি ও নিয়োগনীতির আরও কড়া প্রয়োগের দাবি জেগে উঠবে।

