২০১৫ সালে পাঁচ লাখ পঞ্চাশ হাজার মার্কিন ডলার—বাংলাদেশি মুদ্রায় তিন কোটি টাকারও বেশি—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করে ওয়েলিংটনে বাড়ি কেনেন ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম। শুধু আমেরিকাতেই নয়, রাজধানীর বারিধারা, গুলশান, বসুন্ধরা, নিকুঞ্জ, মাতুয়াইল, যাত্রাবাড়ী, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তার একাধিক বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট ও বিপুল সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, নজরুল ইসলামের মোট সম্পদের পরিমাণ ২০০ কোটি টাকার বেশি। তিনি ঢাকা বোট ক্লাব, ঢাকা ক্লাব ও গুলশান ক্লাবসহ ১৪টি অভিজাত ক্লাবের সদস্য। ৪৫ কোটি টাকার দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তারের পর পাঁচ দিনের রিমান্ডে সম্পদ ও অর্থপাচারের বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন নজরুল ইসলাম। গতকাল সোমবার রিমান্ড শেষে তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ২৩ অক্টোবর গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গতকাল সিএমএম আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় তার জবানবন্দি দেওয়ার কথা থাকলেও দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিচালক মো. মশিউর রহমান প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তা রেকর্ড করতে পারেননি।
দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) আকতারুল ইসলাম বলেন, “অনুসন্ধানে নজরুল ইসলামের বিপুল সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি দেশে ও বিদেশে এসব সম্পদের কথা স্বীকার করেছেন।” দুদকের তথ্য অনুযায়ী, নজরুল ইসলাম ও তার পুরো পরিবার যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। ওয়েলিংটনে কেনা বাড়ির পাশাপাশি ঢাকার বারিধারায় আট কাঠার ওপর ‘পুতুল হাউজ’ নামে একটি ট্রিপ্লেক্স বাড়ি রয়েছে, যা বিদেশিদের ভাড়া দেওয়ার জন্য নির্মিত।
গুলশান-১ এ ভাসাবি রেস্টুরেন্টের পেছনে ৩ হাজার ২০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, বারিধারায় ২ হাজার ৮৪১ বর্গফুটের আরেকটি ফ্ল্যাট, গুলশান-২ এ পাঁচ কাঠার ওপর দোতলা ভবনসহ অফিস, বসুন্ধরার ব্লক-জি’তে সায়েম সোবহান রোডে ৩ হাজার ৬০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট রয়েছে তার নামে। এছাড়া নিকুঞ্জে ‘পুতুল হাউজ’ নামে তিন কাঠার ওপর ডুপ্লেক্স বাড়ি, মাতুয়াইল ও যাত্রাবাড়ীতে দুই কোটি টাকার প্লট, নারায়ণগঞ্জের ভুলতা গাউছিয়ায় যৌথ মালিকানায় ১৮ কোটি টাকার ‘প্রাইম শপ’ কোম্পানি এবং মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে আলু চাষের জন্য বিপুল জমিও কিনেছেন তিনি।

এছাড়া, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স, ফারইস্ট ইসলামী সিকিউরিটিজ, ফারইস্ট ইসলামী প্রোপার্টিজ, সিভিসি ফাইন্যান্স ও ফারইস্ট ফাইন্যান্সসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২০ কোটি টাকার শেয়ার রয়েছে নজরুল ইসলামের নামে। দুদকের অভিযোগ, ২০১৪ সালে ফারইস্টের নামে তোপখানা রোডে ২০৭ কোটি টাকার জমি কেনার সময় নজরুল ইসলামসহ কয়েকজন ২৮ কোটি টাকা ভাগাভাগি করেন, যার মধ্যে তিনি একাই পান ছয় কোটি টাকা। জমি বিক্রেতা আজহার হোসেন খানের কাছ থেকে তিনি নিজের ব্যাংক হিসাবে ১০ কোটি এবং স্ত্রীর হিসাবে ৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা স্থানান্তর করে পাচার করেন।
আরও জানা গেছে, ফারইস্টের প্রতিষ্ঠাতা এম এ খালেক তার নিজের ও পরিচিতদের নামে ১১টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৫৯১ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। ওই অর্থ আত্মসাতে নজরুল ইসলামও জড়িত ছিলেন বলে রিমান্ডে স্বীকার করেছেন তিনি। নজরুল ইসলাম ২০১৬ সালে ১০ লাখ টাকা দিয়ে একটি ক্লাবের সদস্য হন এবং বারিধারা ক্লাবে সদস্যপদ পেতে দেন দুই লাখ টাকা।
দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রীর নামে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। প্রসঙ্গত, গত ৩১ জুলাই কোম্পানির সম্পদ ক্রয়ের নামে ৪৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, এমডি ও আরও ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। মামলায় তাদের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ আনা হয়েছে।

