স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে দীর্ঘদিনের ভয়াবহ দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, আওয়ামী সরকারের সময়ে প্রতি শিক্ষাবর্ষে বই ছাপার বরাদ্দ থেকে বিভিন্ন মহল কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছে।
এই লুটপাটের মূল কৌশল ছিল প্রকৃত চাহিদার চেয়ে বাড়তি সংখ্যা দেখানো। বাস্তবে কম বা প্রয়োজনীয় সংখ্যক বই ছাপা হলেও বিল করা হতো অনেক বেশি। এবারও এমন দুর্নীতির চেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে। আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রায় সাড়ে তিন কোটি বইয়ের চাহিদা কমার মধ্য দিয়ে তা প্রমাণিত হয়েছে। তবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বর্তমান কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে কিছুটা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। কর্মকর্তারা মনে করছেন, চূড়ান্ত সংখ্যার চেয়ে বাস্তবে আরও অন্তত ২০ শতাংশ বই কম প্রয়োজন।
এনসিটিবি এখন নিম্নমানের বই ছাপার অভিযোগে কালোতালিকাভুক্ত বিভিন্ন প্রেসের তথ্য যাচাই করছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব প্রেস বাতিলযোগ্য বই পুনরায় না ছেপে ভিন্ন কৌশলে মোটা অঙ্কের বিল তুলতে চাচ্ছে। ১৯টি চিহ্নিত প্রেসের বিল-ভাউচার বিশেষভাবে যাচাই করা হচ্ছে। প্রমাণিত হলে আর্থিক জরিমানা অথবা কালোতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
অভিযুক্ত প্রেসগুলোর মধ্যে রয়েছে: অক্সফোর্ড প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন, শাফিন প্রেস, রেদওয়ানিয়া প্রেস, লেটার অ্যান্ড কালার, দি গুডলাক প্রিন্টার্স, অ্যারোস্টোক্র্যাটস প্রেস, অনুপম প্রেস, মিলন প্রেস, বর্ণমালা প্রেস, দোয়েল প্রেস, ন্যাশনাল প্রেস, টাঙ্গাইল অপসেট প্রেস, সরকার প্রেস, নাহার প্রেস, নাইমা প্রেস, ঢাকা প্রিন্টার্স, পাঞ্জেরি প্রিন্টার্স, আমাজন প্রেস ও ভাই ভাই প্রেস।
আওয়ামী আমলে পাঠ্যবই ছাপার বিষয়ে বহু দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও কোনো তদন্ত হয়নি। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন কিছু প্রেসের বিরুদ্ধে তদন্ত চালাচ্ছে। এনসিটিবি প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করছে। দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই বিনামূল্যে সরবরাহ করে সরকার। বই ছাপার দায়িত্বে রয়েছে এনসিটিবি। এজন্য হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে এই খাত ঘিরে একটি দুর্নীতির সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, এনসিটিবি কর্মকর্তা, প্রেস মালিক ও জেলা-উপজেলা শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তারা এতে জড়িত বলে অভিযোগ আছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর কিছু রদবদল করা হলেও ছাপার কাজে অভ্যস্ত সিন্ডিকেট এখনও সক্রিয়। এনসিটিবি জানিয়েছে, আগামী শিক্ষাবর্ষের বই ছাপার কাজ দুর্নীতিমুক্ত করার নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে বইয়ের মান নিশ্চিত করতে কঠোর অবস্থান নেওয়া হচ্ছে।
এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরী জানিয়েছেন, চলতি ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ৩৯ কোটি ৬০ লাখ ৪৩ হাজার ৯২০ কপি বই ছাপা হয়েছিল। ২০২৬ শিক্ষাবর্ষে ছাপা হবে ৩০ কোটি দুই লাখ ৫৫ হাজার ১৫৪ কপি। এর মধ্যে মাধ্যমিকের বই ১১ কোটি ১৭ লাখ ৪৬ হাজার কপি, প্রাথমিকের বই ১৮ কোটি ৮৫ লাখ ৯ হাজার ১৫৪ কপি।
এবার দশম শ্রেণির প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বই ছাপা হচ্ছে না। প্রায় সাড়ে তিন কোটি বইয়ের চাহিদা কমায় সরকার প্রায় ২০০ কোটি টাকা সাশ্রয় করছে। বই ছাপার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রাথমিকের জন্য ৪২৫ কোটি এবং মাধ্যমিকের জন্য এক হাজার ৫৭০ কোটি টাকা।
এনসিটিবির সচিব অধ্যাপক সাহতাব উদ্দিন বলেন, বইয়ের বাড়তি চাহিদা কমাতে আমরা বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছি। প্রথমে প্রদত্ত চাহিদা সন্দেহজনক মনে হয়ে কয়েক দফা রিভাইজ করতে বলা হয়েছে। এতে অনেক কমেছে, তবে এখনো কিছু বই বেশি ছাপা হচ্ছে। আরও দুবছর কাজ করলে কমানো সম্ভব।
তিনি আরও জানান, স্কুল পরিদর্শনের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যেখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৯০, সেখানে বইয়ের চাহিদা দেওয়া হয়েছে ১৬০ কপি। অনেক স্কুলে শিক্ষার্থীর চেয়ে বেশি চাহিদা দেখানো হয় বই নষ্ট হওয়ার বা ছাত্রদের আসা-যাওয়া ইত্যাদি কারণ দেখিয়ে। নিয়ম অনুযায়ী পাঁচ শতাংশ বেশি বই চাওয়া যায়।
প্রেস মালিক ও এনসিটিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছে, বাড়তি চাহিদা দেখিয়ে বই ছাপায় সরকার খরচ দিচ্ছে। তবে প্রকৃতপক্ষে কম বই ছাপা হয়। ডেলিভারির সময় পরিদর্শক ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বিল-ভাউচারে উল্লেখিত সংখ্যার চেয়ে কম বই সরবরাহ করা হয়। কাগজের মান কমানো, সাইজ ছোট করা, টেন্ডার কারসাজিসহ নানা কৌশলে দুর্নীতি হয়। পরিদর্শনের জন্য দায়িত্বরত কোম্পানির মাধ্যমেও দুর্নীতি হয়।
এনসিটিবি সচিব সাহতাব উদ্দিন জানিয়েছেন, এবার কম বই ছাপা হলেও বেশি বিল করার সুযোগ নেই। বই ছাপার কাজ সিসিটিভি মনিটরিং ও লাইভ ডেটা মনিটরিং-এর মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। ডেলিভারির সময় বই গুনে নেওয়া হচ্ছে। বইয়ের মান নিশ্চিত করতে অফ হোয়াইট কাগজ ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতিটি বইয়ে প্রকাশিত প্রেসের নাম লেখা থাকবে। দুইটি ল্যাবে কাগজের মান পরীক্ষা করা হচ্ছে।
এখন প্রাথমিকের ৩২ শতাংশ নতুন বই বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে গেছে। ৫৭ শতাংশ বই ছাপা শেষ। বাকি বই দ্রুত স্কুলে পৌঁছে যাবে। তবে হবিগঞ্জে কিছু বইয়ের মানে ত্রুটি ধরা পড়ায় ফেরত এসেছে। অগ্রণী প্রেসকে শোকজ ও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরীর মন্তব্য জানতে চাওয়া হলেও মন্ত্রণালয় নিষেধাজ্ঞার কারণে সাক্ষাৎ দিতে রাজি হননি।

