দুই উপদেষ্টার সাবেক সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তার (পিও) দুর্নীতির ফাইল দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ‘ডিপ ফ্রিজে’ চলে গেছে। তারা হচ্ছেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার এপিএস মো. মোয়াজ্জেম হোসেন এবং স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের পিও তুহিন ফারাবী।
তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধান ভাটা পড়েছে। সংস্থার গোয়েন্দা ইউনিট অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে। তবুও প্রকাশ্য অনুসন্ধান শুরুর সাত মাস পার হতে চললেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। মিডিয়ায় শোরগোল ও সমালোচনার পরও দুদক কার্যত অনুসন্ধান স্থগিত করেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্ষমতার ছায়ায় থাকা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্তে দুদকের পুরোনো চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সরকারবিরোধী দুর্নীতির অনুসন্ধানে আগ্রহী ছিল। বর্তমানেও এমনটাই দেখা যাচ্ছে। তবে উপদেষ্টাদের পিএস, এপিএস, পিও, স্বজন ও আমলাদের বিরুদ্ধে এক বছরের বেশি সময় ধরে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এক বছর আগে অবসরপ্রাপ্ত, পলাতক ও চাকরিরত সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তদন্ত শুরু হলেও তা শেষ হয়নি। অন্যদিকে, গত সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী সমর্থক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
দুদকের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন বলেন, দুই উপদেষ্টার এপিএস ও পিও-এর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলমান। এখনো তাদের বিরুদ্ধে অকাট্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধানে প্রমাণ মিললে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘দুদক সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে। সব ধরনের দুর্নীতি একা দমন সম্ভব নয়। কোনো ধরনের চাপের মধ্যে নেই। যে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল) মঈদুল ইসলাম বলেন, ‘যে সরকার যেমনভাবে চালাতে চায়, তেমনভাবেই দুদক চলে। সরকারের মর্জি-মেজাজ অনুযায়ী কাজ করা দুদকের বরাবরের ধারা। বর্তমান ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে কিছু করার সামাজিক বা রাজনৈতিক পরিস্থিতি নেই। অতীতেও এরকম হয়েছে। এ কারণেই দুদকের এমন মাজা ভাঙা অবস্থা।’
দুই উপদেষ্টার এপিএস ও পিও-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে ঘুষ বাণিজ্য, কেনাকাটায় কমিশন বাণিজ্য এবং পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেওয়া। প্রতিবেদন প্রকাশের পর দুদক গোপন তদন্ত শুরু করে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মাধ্যমে তাদের ব্যাংক হিসাববিবরণী সংগ্রহ করা হয়। অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেলে পৃথক দুটি অনুসন্ধান টিম তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে। এছাড়া এনসিপির সাবেক যুগ্ম সদস্য সচিব এবিএম গাজী সালাউদ্দিন আহমেদ তানভীর ও ডা. মাহমুদুল হাসানকেও তলব করা হয়।
তলবকালে তারা নির্ধারিত দিনে হাজির হননি। পরবর্তী দিনে সেগুনবাগিচায় দুদকের কার্যালয়ে হাজির হয়ে তাদের বক্তব্য দেন। এরপর অনুসন্ধানে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। সংশ্লিষ্টরা জানান, শঙ্কার কারণে অনুসন্ধান টিম গভীরে যেতে পারছে না। যদিও ব্যাংক হিসাব ও অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্যপ্রমাণ টিমের কাছে রয়েছে। বিএফআইইউ তথ্য আগে থেকেই দুদকে পাঠিয়েছে। তথ্যের ভিত্তিতেই মামলা দায়ের করা সম্ভব, তবে প্রভাবশালী মহল সীমারেখা টেনে দিয়েছে। অভিযুক্তরা দায়িত্ব থেকে সরানো হয়েছে, এ ছাড়া কোনো সত্যতা না থাকলে সরানো হতো না। ফলে মামলা দায়েরে বাধা রয়েছে।
টিআইবি-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনুসন্ধান না হওয়া হতাশাজনক। কগনিজেবল প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও যদি কোনো অগ্রগতি না হয়, দুদকের পূর্বের চর্চার ধারক হয়ে যাচ্ছে। এটি দেশবাসীর জন্যও হতাশার খবর। নির্বাচনের পর পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।’
উপদেষ্টাদের এপিএস ও পিও-এর দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করার দাবি নিয়ে যুব অধিকার পরিষদ দুদকের সামনে অবস্থান নেয়। ‘মার্চ টু দুদক’ কর্মসূচিতে নেতাকর্মীরা স্মারকলিপি জমা দেন। হাইকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট নাদিম মাহমুদ ও অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ শফিকুল ইসলামও একই ধরনের অভিযোগ দুদকে দাখিল করেন। তবে অনুসন্ধানে দুদকের নিষ্ক্রিয়তা অব্যাহত আছে।
প্রসঙ্গত, ২২ এপ্রিল প্রজ্ঞাপন জারি করে যুব ও ক্রীড়া এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আগে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের পিও তুহিন ফারাবীকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া, ২১ এপ্রিল এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে দল থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে পাঠ্যবই কেনায় কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে।

