বাংলাদেশ ব্যাংকের ইউজার আইডি ব্যবহার করে একটি প্রতারকচক্র গ্রাহকের সঞ্চয়পত্র থেকে অর্থ তুলে নিয়েছে। এ ঘটনায় মতিঝিল থানায় চারজনকে আসামি করে মামলা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আসামিরা হলেন—আরিফুর রহমান মিম, মারুফ এলাহী, আল আমিন ও মহিউদ্দিন আহমেদ। তাদের মধ্যে আরিফুর রহমানকে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মতিঝিল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
জানা গেছে, সঞ্চয় অধিদপ্তরের সার্ভারে ত্রুটির সুযোগ নিয়ে এ প্রতারণা ঘটেছে। গ্রাহক যখন সঞ্চয়পত্রের ব্যাংক হিসাব পরিবর্তন করতে চায়, তখন মোবাইলে ওটিপি যায়। ওটিপি দিলে হিসাব পরিবর্তন হয়। কিন্তু গ্রাহকের মোবাইল নম্বর পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কোনো ওটিপি যাচাইয়ের ব্যবস্থা ছিল না। প্রতারকচক্র এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রথমে মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করে। এরপর নাম ও ব্যাংক হিসাব পরিবর্তন করে অর্থ তুলে নেয়।
মামলার নথি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত ১৩ অক্টোবর পাঁচ বছর মেয়াদি ২৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ক্রয় করেন মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রেজভী। ২৭ অক্টোবর তিনি আয়কর রিটার্ন পূরণ করতে গিয়ে দেখেন তার সঞ্চয়পত্র নগদায়ন করা হয়েছে। বিষয়টি তিনি সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানান। যাচাইয়ে দেখা যায়, ২৩ অক্টোবর সঞ্চয়পত্র নগদায়ন করা হয়েছে, অথচ শাখার কোনো নথিতে নগদায়নের আবেদন নেই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্ট্রেংদেনিং পাবলিক ফাইন্যানশিয়াল ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস (এসপিএফএমএস)-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারে, ২২ অক্টোবর গ্রাহকের মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করা হয়েছে। এরপর আরিফুর রহমান নামের এক ব্যক্তি গ্রাহকের ব্যাংক হিসাব পরিবর্তন করে দিনাজপুরের এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ৩০৪১৩১১০০০১৬৭৪১ নং হিসাব নম্বরে। ২৩ অক্টোবর সঞ্চয়পত্র নগদায়ন করা হয়। আরিফুর রহমানের ব্যাংক ট্রানজেকশন বিশ্লেষণে দেখা যায়, তার উত্তোলন ও জমার সীমা প্রথমে দুই লাখ টাকা ছিল। পরে এটি টেম্পারিং করে ১০ লাখ টাকায় পরিবর্তন করা হয়।
এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রতারকচক্র মূলত ফিক্সড সঞ্চয়পত্র লক্ষ্য করেছে। কারণ ফিক্সড সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষ হলে সুদসহ পুরো অর্থ গ্রাহকের হিসাব চলে যায়। মাসিক সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে মাস শেষে সুদ যায়। গ্রাহক যেন বুঝতে না পারেন, তাই তারা দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়পত্রকে টার্গেট করেছে।
এ একই পদ্ধতিতে সাইদুর রহমান ও আবুল হাসান মজুমদারের পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রও ভাঙানো হয়। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মাধ্যমে ৩০ লাখ ও ২০ লাখ টাকা উত্তোলনের চেষ্টা করা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক তা আটকে দেয়। টাকা উদ্ধার করে সরকারি খাতে জমা দেওয়া হয়েছে। প্রতারকচক্রের মূল হোতা সাবেক ছাত্রদল নেতা মারুফ এলাহী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের ২০০৭–০৮ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। ছাত্রদলের সহ-সভাপতি এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদও সামলেছেন।
মারুফ এলাহী নামের আরেক ব্যক্তি গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট পরিবর্তন করে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখায় নিজের ১০৭১০১০০৮৪৭৮২ নং হিসাব যুক্ত করেন। পরবর্তীতে এটি নগদায়ন করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে কম্পিউটার সেলের মাধ্যমে এই ইএফটি দুটি স্থগিত করে। ফলে প্রতারকচক্র ব্যর্থ হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সন্দেহভাজন তিনটি ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এছাড়া মতিঝিল অফিসের তিন কর্মকর্তার কম্পিউটারও জব্দ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “ঘটনাটি জানার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। মতিঝিল থানায় সাধারণ ডায়েরি ও মামলা করা হয়েছে। ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্ত শেষ হলে পুরো বিষয়টি বোঝা যাবে।”
সঞ্চয় অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। মহাপরিচালক ড. রওশন আরা বেগম ফোন রিসিভ করেননি এবং মেসেজের কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। ঘটনার জেরে আপাতত মতিঝিল অফিসের সঞ্চয়পত্র বেচাকেনা বন্ধ রয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, গ্রাহকরা সঞ্চয়পত্রের খোঁজ নিচ্ছেন। কর্মকর্তারা জানান, আগামী সপ্তাহ থেকে কার্যক্রম পুনরায় শুরু হবে।

