বাংলাদেশের ১৭ কোটির বেশি মানুষের চিকিৎসাসেবা নির্ভর করছে মাত্র দেড় লাখ ডাক্তারের ওপর। গড়ে প্রতি ১২০০ জনের জন্য আছেন একজন চিকিৎসক। ফলে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও চেম্বারে রোগীর দীর্ঘ সারি এখন নিত্যচিত্র। কিন্তু এই পেশার পেছনের বাস্তবতা শুধু চিকিৎসা নয়, লুকিয়ে আছে বিশাল অঙ্কের অর্থ আর অপ্রদর্শিত আয়ের গল্প।
চিকিৎসার নামে বিপুল অর্থ ঘুরে বেড়াচ্ছে ডাক্তারদের হাতে। দরিদ্র রোগীর চিকিৎসা ফি, নানা পরীক্ষার খরচ—সব মিলিয়ে গড়ে চিকিৎসা খাতে বছরে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা। এই টাকার বড় অংশই যাচ্ছে ব্যক্তিখাতের চিকিৎসকদের পকেটে। অথচ সেই আয়ের একটি বড় অংশই সরকারের আয়কর ব্যবস্থায় প্রতিফলিত হচ্ছে না।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশে অন্তত ১০ হাজার চিকিৎসক বছরে প্রায় ৬ হাজার ২৫০ কোটি টাকার কর ফাঁকি দিচ্ছেন। কেউ কেউ ধরা পড়লে জরিমানা দিয়ে কর পরিশোধ করেন কিন্তু বেশিরভাগই এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন।
দুই শীর্ষ চিকিৎসকের আয় ও কর ফাঁকি অনুসন্ধান
রাজধানীর দুই প্রখ্যাত চিকিৎসককে ঘিরে করা অনুসন্ধানে কর ফাঁকির স্পষ্ট চিত্র উঠে এসেছে। তাঁদের একজন নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. কাজী দ্বীন মোহাম্মদ, অন্যজন বারডেম জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডা. এ কে এম মূসা।
ডা. দ্বীন মোহাম্মদ কর অঞ্চল–২৩-এর করদাতা। নথি অনুযায়ী, তাঁর ২০২৩–২৪ করবর্ষে আয় দেখানো হয়েছে ৭ লাখ ৪৮ হাজার টাকা, আর সম্পদ ৫৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা। পরের করবর্ষে আয় দেখানো হয় ৭ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। অথচ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তিনি প্রতিদিন গড়ে ৫০ জন রোগী দেখেন, প্রতিজনের ফি ১৫০০ টাকা।
তাহলে দিনে আয় ৭৫ হাজার টাকা, মাসে প্রায় ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা, আর বছরে ২০০ দিন চেম্বার করলে কেবল ফি থেকেই আয় প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি রোগী, টেস্ট কমিশন ও ওষুধ কোম্পানির পেমেন্ট যোগ করলে বার্ষিক আয় দাঁড়ায় অন্তত ৩ কোটি টাকা। অথচ কর রিটার্নে এসব আয়ের কোনো উল্লেখ নেই।
কর ফাঁকির বিষয়ে জানতে চাইলেও ডা. দ্বীন মোহাম্মদ কোনো মন্তব্য করেননি।
ডা. এ কে এম মূসা, কর অঞ্চল–১০-এর করদাতা। তাঁর আয়কর নথি অনুযায়ী, ২০২৪–২৫ করবর্ষে আয় দেখানো হয়েছে ৪৬ লাখ টাকা। তবে সরেজমিনে দেখা গেছে, তিনি আলোক হেলথকেয়ার ও ল্যাবএইড হাসপাতালে সপ্তাহে ১০ দিন পর্যন্ত চেম্বার করেন।
আলোক হেলথকেয়ারে প্রতিদিন গড়ে ৩৫ জন রোগী দেখেন, গড় ফি ১১০০ টাকা। ল্যাবএইডে গড় ফি ১১৫০ টাকা। এই দুই হাসপাতালে চেম্বার থেকে দৈনিক গড় আয় হয় ৪৩ হাজার টাকা, অর্থাৎ বছরে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
এর বাইরেও তিনি রোগীদের নানা টেস্টের নির্দেশ দেন—রক্ত পরীক্ষা, এক্স-রে, আল্ট্রাসাউন্ড, সিটিস্ক্যান, এমআরআই ইত্যাদি। এসব পরীক্ষার পেছনে ডাক্তারদের কমিশন থাকে ২০–৫০ শতাংশ পর্যন্ত। পাশাপাশি ওষুধ কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় ব্র্যান্ডভিত্তিক প্রেসক্রিপশন থেকেও আসছে বড় অঙ্কের আয়।
তথ্য অনুযায়ী, কেবল রোগী দেখার ফি-ই কর রিটার্নে দেখানো আয়ের চেয়ে অন্তত ৮৩ লাখ টাকা বেশি। কমিশন ও ওষুধ কোম্পানির আয়সহ তা ২ কোটি টাকার বেশি। কর ফাঁকির বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
ফাঁকির পরিমাণ ও আইনগত দায়
তদন্তে দেখা গেছে, এই দুই চিকিৎসক বছরে গড়ে প্রায় ৫ কোটি টাকার আয় গোপন করেছেন। এতে সরকারের ক্ষতি হয়েছে কমপক্ষে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা কর। পাঁচ বছরে তাঁদের দুজনের ফাঁকির অঙ্ক দাঁড়ায় প্রায় ৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
২০২৪ সালের শেষ নাগাদ দেশে নিবন্ধিত চিকিৎসকের সংখ্যা ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৯৯ জন। জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতি হাজার জনে চিকিৎসক আছেন মাত্র ০.৮৩ জন।
কর কর্মকর্তারা বলছেন, উচ্চ আয়ের চিকিৎসকদের বেশিরভাগই সঠিকভাবে কর দেন না। তাঁদের মধ্যে অন্তত ১০ হাজার ডাক্তার বছরে গড়ে ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে কর ফাঁকি দেন, যা মোট ৬২৫০ কোটি টাকা। যদি এ প্রবণতা পাঁচ বছর ধরে চলে, তাহলে অঙ্ক দাঁড়াবে ৩১,২৫০ কোটি টাকা—যা দিয়ে নতুন একটি মেট্রোরেল প্রকল্প নির্মাণ সম্ভব।
আয়কর আইন ২০২৩ অনুযায়ী, আয় গোপন করা বা ভুয়া তথ্য প্রদান ইচ্ছাকৃত কর ফাঁকি হিসেবে গণ্য হয়। এ ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
তবে কর কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রেই এসব চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কার্যকর অডিট চালানো যায় না। তাঁদের বেশিরভাগ লেনদেন হয় নগদে, ব্যাংক হিসাবের বাইরে। ফলে রাষ্ট্র হারাচ্ছে বিপুল রাজস্ব।
সরকারি পদক্ষেপ ও তদারকি ব্যবস্থা
কর প্রশাসনের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বর্তমানে প্রতিটি কর অঞ্চলে গোয়েন্দা ও তদন্ত সেল (IIC) গঠন করা হয়েছে। এসব সেল সন্দেহভাজন কর ফাঁকির মামলা নিয়ে কাজ করছে। কর প্রশাসন ও মানবসম্পদ বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, “রাজস্ব বৈঠকে কমিশনারদের কর ফাঁকি দমন জোরদারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”
তবে মাঠ পর্যায়ের তদারকি ও বাস্তব প্রয়োগ এখনো সীমিত বলেই স্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সেরা করদাতার আড়ালে ফাঁকি
দেশের শীর্ষ চিকিৎসক ও স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত ডা. প্রাণ গোপাল দত্তও সম্প্রতি কর ফাঁকি দেওয়ার ঘটনায় আলোচনায় আসেন। তিনি টানা আটবার “সেরা করদাতা” হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায়, তিনি এফডিআর তথ্য গোপন করে কর ফাঁকি দেন।
প্রাথমিকভাবে তিনি ১ কোটি ৭২ লাখ টাকার কর ফাঁকি পরিশোধ করেছেন। বিষয়টি নিয়ে এখনো তদন্ত চলছে।
রাজস্ব ঘাটতি ও কর ফাঁকির প্রভাব
চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব লক্ষ্য ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে আয়কর খাতের লক্ষ্য ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা; এর মধ্যে আয়কর খাতে ঘাটতি ৬,৫৪১ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এই ঘাটতির অন্যতম কারণ কর ফাঁকি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র গবেষণা সহযোগী তামীম আহমেদ বলেন, “কর ব্যবস্থায় দুর্বল তদারকির কারণেই অনেকে প্রকৃত আয় গোপন করছেন। ইচ্ছাকৃতভাবে আয় কম দেখানো একটি ফৌজদারি অপরাধ। যদি কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে উদাহরণ হিসেবে শাস্তি দেওয়া যেত, তাহলে কর ফাঁকির প্রবণতা অনেক কমে যেত।”
চিকিৎসা পেশা মানুষের জীবনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। অথচ এখানেই চলছে আয়ের বিশাল অংশ গোপনের প্রবণতা। রাষ্ট্র হারাচ্ছে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব, আর সাধারণ মানুষ ব্যয় করছে বিপুল অর্থ চিকিৎসার পেছনে। কর প্রশাসন যদি কার্যকর নজরদারি ও স্বচ্ছ হিসাবব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে এই হারানো রাজস্ব থেকেই গড়া সম্ভব আরও হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ ও জনস্বাস্থ্য প্রকল্প।

