রাজধানীর আবাসিক এলাকায় এখনো অবাধে চলছে বিপজ্জনক রাসায়নিক ও প্লাস্টিক ব্যবসা, যা নাগরিকদের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি ও প্রাণহানির আশঙ্কা তৈরি করছে। গত ১৫ বছরে একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পরও এসব ব্যবসা স্থানান্তরের সরকারি উদ্যোগ কার্যকর হয়নি।
২০১০ সালের নিমতলী অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ১২৪ জন নিহত হওয়ার পর সরকার এসব ব্যবসা স্থানান্তরের উদ্যোগ নেয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) রাসায়নিক ও প্লাস্টিক শিল্প স্থানান্তরের দুটি পৃথক প্রকল্প হাতে নেয় ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে। তবে প্রকল্পগুলোর তিনটি নির্ধারিত সময়সীমাই পেরিয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপজ্জনক এসব ব্যবসা সরাতে ব্যর্থতা মূলত সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর দুর্বল সমন্বয় ও আইন প্রয়োগের অভাবের প্রতিফলন। ব্যবসায়ীরা প্রশাসনিক ফাঁকফোকর ব্যবহার করে আবাসিক এলাকায় অবৈধভাবে এসব ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
গত ১৪ অক্টোবর মিরপুরের রূপনগরে একটি গার্মেন্ট কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১৭ জন নিহত হওয়ার পর বিষয়টি আবারও জনআলোচনায় আসে। অগ্নিনির্বাপক কর্মকর্তারা জানান, আগুনের সূত্রপাত পাশের একটি রাসায়নিক গুদাম থেকে হয়।
মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা ও পুরান ঢাকার বাসিন্দারা জানান, এসব এলাকায় এখনো ডজন ডজন রাসায়নিক ও প্লাস্টিক কারখানা ও গুদাম চলছে, যা প্রতিনিয়ত ঝুঁকির সৃষ্টি করছে।
যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলেন, “আমরা সবসময় ভয় নিয়ে বাঁচি। যে কোনো সময় আবার বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।”
বিস্ফোরক পরিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা বিভাগে ৫৪ ধরনের দাহ্য রাসায়নিক সংরক্ষণ ও বিক্রির লাইসেন্স রয়েছে ৭৩১ প্রতিষ্ঠানের। তবে কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, আরও বহু অবৈধ রাসায়নিক ব্যবসা কোনো অনুমতি ছাড়াই চলছে।
প্রধান পরিদর্শক হায়াত মো. ফিরোজ বলেন, “যেসব রাসায়নিক সরাসরি দাহ্য নয়, সেগুলোর জন্য লাইসেন্স লাগে না—এ ফাঁকফোকরই অনেকে ব্যবহার করছে।” তিনি জানান, নতুন বিধি প্রণয়নের মাধ্যমে সব সংস্থার কার্যক্রম সমন্বয়ের উদ্যোগ চলছে।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও স্বীকার করেছে, লাইসেন্স ছাড়াই এসব ব্যবসা চলছে। দক্ষিণ সিটির উপপ্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা শাহখান আলী বলেন, “আমরা কোনো রাসায়নিক ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স দিইনি, কিন্তু অনেকেই অন্য ব্যবসার নামে এই কাজ করছে।”
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক ব্যবসা শুধু অগ্নিঝুঁকি নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকিও সৃষ্টি করে। “মিশ্র জোনিংয়ের নামে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিপজ্জনক ব্যবসা চালানোর অনুমতি দেওয়া হচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়ংকর,” তিনি বলেন।
২০১৯ সালে চকবাজারের ওয়াহেদ ম্যানশন অগ্নিকাণ্ডে ৭০ জন নিহত হওয়ার পর দক্ষিণ সিটি করপোরেশন পুরান ঢাকায় অন্তত ১,৯২৪টি রাসায়নিক প্রতিষ্ঠান শনাক্ত করে। তবে বাসিন্দা ও নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
২০১৮ সালে ৩১০ একর জমিতে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে ১ হাজার ৫০০ রাসায়নিক কারখানা স্থানান্তরের জন্য ‘বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’ প্রকল্প অনুমোদন পায়। ১,৪৫৪.৮ কোটি টাকার এই প্রকল্প তিনটি সময়সীমা পার করেছে। এখন এর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, “৩১০ একরের মাটি ভরাট কাজ শেষের পথে। প্রকল্পের ৭৩ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।”
অন্যদিকে, ‘বিসিক প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’ প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৫ সালে, পুরান ঢাকা থেকে ৩৯১টি প্লাস্টিক কারখানা কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরের জন্য। তবে স্থানীয়দের প্রতিবাদে প্রকল্পটি প্রথমে মুন্সিগঞ্জে, পরে ২০২২ সালে দোহার রোড সংলগ্ন এলাকায় সরানো হয়।
প্রকল্প পরিচালক মো. আনিস উদ্দিন জানান, “জমি অধিগ্রহণ শেষ হয়েছে জুনে, তবে কাজের অগ্রগতি মাত্র ১২ শতাংশ।” ফলে প্রকল্পের নির্ধারিত সময়সীমা ২০২৫ সালের ডিসেম্বরেও শেষ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
অগ্নি ও নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, এই বিলম্বের কারণে ঢাকাবাসী এখনো ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা বলেন, পুরান ঢাকা, যাত্রাবাড়ী ও মিরপুরের মিশ্র ভবনগুলোয় দাহ্য ও বিক্রিয়াশীল রাসায়নিক একসঙ্গে মজুত থাকায় বড় অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কা সবসময় থেকেই যায়।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের টঙ্গীতে এক রাসায়নিক গুদামের আগুনে তিন দমকল কর্মীসহ চারজন প্রাণ হারান।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক তৎপরতা না থাকলে পুনর্বাসন কার্যক্রম দ্রুত এগোবে না। নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মোহাম্মদ খানের ভাষায়, “স্থানান্তর এখন রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রশ্ন। যত দেরি হবে, তত বাড়বে প্রাণহানি।”
বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকল্পগুলোর মেয়াদ ২০২৭ সাল পর্যন্ত গড়ানোয় রাজধানীর হাজারো মানুষ আগুন ও বিষাক্ত রাসায়নিকের দ্বৈত ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন।

