চুয়াডাঙ্গার ডিঙ্গেদহে বিসিক শিল্পনগরীতে ঢুকতেই চোখে পড়ে এক অচেনা নীরবতা। চারপাশ জঙ্গল-আগাছায় ভরা, রাস্তা ভাঙাচোরা, প্লটগুলো পরিত্যক্ত। প্রকল্পজুড়ে দেখা মেলে ভবনহীন তারঝুলানো খালি জায়গা আর নিরাপত্তাহীন পরিবেশ—সব মিলিয়ে যেন এক ভুলে যাওয়া প্রকল্পের দৃশ্যপট।
সরকার ২০২১ সালে ২৫ দশমিক ২ একর জমির ওপর প্রায় ৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে এই শিল্পনগরী গড়ে তোলে। লক্ষ্য ছিল স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্য শিল্পায়নের নতুন দিগন্ত তৈরি করা, কর্মসংস্থান বাড়ানো এবং জেলার অর্থনীতিতে গতি আনা। কিন্তু চার বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পটিতে এখনো প্রাণ ফেরেনি।
৭৮টি প্লটের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র ৩১টিতে। এর মধ্যে ছয়টি বরাদ্দ বাতিল হয়েছে নানা জটিলতায়। বরাদ্দ পাওয়া ২৫ উদ্যোক্তার মধ্যে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন মাত্র তিনজন। বাকি সব প্লট পড়ে আছে খালি। কিছু জায়গায় ইটের গাঁথুনি শুরু হলেও কাজ থেমে গেছে মাঝপথে।
সরেজমিনে দেখা যায়, পুরো এলাকা এখন আগাছায় ঢেকে গেছে। ভাঙা ড্রেনেজ ব্যবস্থায় বৃষ্টি হলেই জমে থাকে পানি। সৃষ্টি হয় মশার উপদ্রব ও দুর্গন্ধ। সন্ধ্যা নামলেই ডুবে যায় অন্ধকারে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় উদ্যোক্তাদের মনে তৈরি হয় ভয়। ফলে একসময় যেখানে কর্মচাঞ্চল্যের আশা ছিল, সেখানে এখন পায়ের আওয়াজও বিরল।
চুয়াডাঙ্গা ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি মঞ্জুরুল আলম মালিক লার্জ বলেন,
“প্রকল্পটি মূলত থেমে আছে। সরকারি অর্থ ব্যয় হলেও পরিকল্পনার ঘাটতি স্পষ্ট। উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী নন, কারণ এখানে ব্যবসা মানেই ঝুঁকি নেওয়া।”
স্থানীয় বাসিন্দা কামরুল হোসেন বলেন,
“বিসিক হলে ভেবেছিলাম এলাকায় কাজের সুযোগ বাড়বে। কিন্তু কিছুই হলো না। এখন শুধু আগাছা আর নীরবতাই বাড়ছে।”
তবে চুয়াডাঙ্গা বিসিকের উপব্যবস্থাপক এ বি এম আনিসুজ্জামান আশাবাদী। তিনি জানান, মোট প্লটের ৪০ শতাংশ ইতিমধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, বাকিগুলোও শিগগির দেওয়া হবে। যাঁরা বরাদ্দ নিয়েও কাজ শুরু করেননি, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
“কারখানাগুলো চালু হলে কর্মসংস্থান বাড়বে,” বলেন তিনি।
কিন্তু বাস্তবে চিত্রটি ভিন্ন। চার বছর ধরে অব্যবহৃত পড়ে থাকা এই প্রকল্প এখন সরকারি বিনিয়োগের দক্ষতা ও দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। প্রায় ৪২ কোটি টাকার এ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ফলাফল হতাশাজনক।
উদ্যোক্তারা অভিযোগ করছেন, এখানে পানি, বিদ্যুৎ, রাস্তা, নিরাপত্তা, ড্রেনেজ—কোনোটিই সন্তোষজনক নয়। অবকাঠামো দুর্বল, পরিবেশ অনুপযুক্ত। ফলে অনেকেই জমি পেলেও কাজ শুরু করতে পারেননি।
অর্থনীতিবিদদের মতে, শিল্পনগরী কেবল ভবন বা প্লট দিয়ে টিকে থাকে না; এর সঙ্গে থাকতে হয় প্রণোদনা, সুযোগ-সুবিধা ও প্রশাসনিক সহায়তা। চুয়াডাঙ্গার বিসিক প্রকল্পে এসবের ঘাটতি স্পষ্ট।
দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা ও অবহেলা এখন প্রকল্পটিকে ধীরে ধীরে নষ্ট করে দিচ্ছে। কিছু জায়গায় নতুন ভবন উঠলেও পাশে জন্ম নিচ্ছে আগাছা। যেন জীবন্ত উদাহরণ—কীভাবে পরিকল্পনার অভাব এক সম্ভাবনাময় প্রকল্পকে পরিণত করতে পারে জঙ্গলে।

