গুলশানে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) চেয়ারম্যানের সরকারি বাসভবন সংস্কারকাজে গুরুতর অনিয়ম পাওয়া গেছে। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি এই অনিয়ম নিশ্চিত করেছে। এর আগে রাজউক নিজস্ব তদন্তে কোনো অনিয়ম খুঁজে পায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংস্থাটির সেই তদন্ত ছিল ‘লোক দেখানো’।
তদন্ত কমিটি জানিয়েছে, বাসভবনের ৮০ শতাংশ সংস্কারকাজ শেষ হওয়ার পর দরপত্র আহ্বান করা হয়। প্রথমে খরচ ধরা হয়েছিল ৩০ লাখ টাকা, কিন্তু কাজ শেষ করতে খরচ হয়েছে দুই কোটি ১৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ, প্রাক্কলনের প্রায় সাত গুণ টাকা খরচ হয়েছে।
অনিয়মে রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. ছিদ্দিকুর রহমান, প্রধান নগর স্থপতি মোস্তাক আহমেদ এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রাহাত মুসলেমীনের জড়িত থাকার বিষয়টি তদন্তে ধরা পড়েছে। গণপূর্ত কমিটি দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে। তবে সাবেক চেয়ারম্যান ছিদ্দিকুর রহমান গত ২৪ অক্টোবর মারা গেছেন। চেয়ারম্যান বাংলো গুলশানের ৬ নম্বর সড়কের ১ নম্বর প্লটে অবস্থিত। তদন্তে উঠে এসেছে, গত বছর মার্চে লুকোচুরি করে সংস্কারকাজ শুরু হয়। পরে গত জানুয়ারি মাসে কাগজে-কলমে দরপত্র আহ্বান করা হয় এবং মেসার্স নিয়াজ ট্রেডার্সকে ঠিকাদার করা হয়।
বাংলো সংস্কারকাজে অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর রাজউক গত মে মাসে নিজস্ব তদন্তে নামে। এক সপ্তাহ পর রাজউকের তদন্ত দল জানায়, কোনো অনিয়ম হয়নি। তবে ২৯ জুন গণপূর্ত মন্ত্রণালয় দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। এই কমিটি ২৭ আগস্ট মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয় এবং সংস্কারকাজের অনিয়ম নিশ্চিত করে।
মন্ত্রণালয় ও রাজউক দায়ীদের রক্ষা করার চেষ্টা করে। তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিয়ে, শুধু কাজের গুণগতমান নিরীক্ষা করে ঠিকাদারকে চূড়ান্ত পাওনা পরিশোধের জন্য রাজউককে ৮ অক্টোবর চিঠি দেয় মন্ত্রণালয়। এরপর এই ঘটনায় জড়িত দুই কর্মকর্তা প্রধান নগর স্থপতি মোস্তাক আহমেদ ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রাহাত মুসলেমীনকে ১৩ অক্টোবর কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়।
রাজউক সূত্রে জানা যায়, গত ৫ এপ্রিল ছিদ্দিকুর রহমান চেয়ারম্যান হওয়ার আগে বাংলো সংস্কারের জন্য প্রকৌশল বিভাগ ৩০ লাখ টাকার প্রাক্কলন তৈরি করে। তবে আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের প্রকৌশলী দল ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে ভেঙে নতুন নির্মাণের সুপারিশ করেন। ১৭ জুলাই নির্বাহী প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন-৪) নতুন ভবনের নকশা প্রস্তুতির জন্য চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দেন।
কর্তৃপক্ষ এটি উপেক্ষা করে ৯ মে প্রধান নগর স্থপতি মোস্তাক আহমেদকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করে। কমিটি নকশা অনুমোদন ও দরপত্র ছাড়া, মৌখিক নির্দেশে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্সের মাধ্যমে ৯টি অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের সংস্কারকাজ শুরু করে। রাজউক বাস্তবায়ন-৪-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ কাইছার বাধা দেন। তিনি লিখিত নির্দেশনা, কাজের পরিকল্পনা ও অনুমোদিত নকশার কপি চেয়ে চিঠি দেন। কিন্তু ৯ জুন তখনকার চেয়ারম্যানের চাপের কারণে চিঠি প্রত্যাহার করা হয়।
মার্চে কাজ শুরু হলেও অক্টোবরের মধ্যে নকশা তৈরি করা হয় এবং দুই কোটি ৮৫ লাখ টাকার প্রাক্কলনে সইয়ের জন্য প্রধান প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিককে চাপ দেওয়া হয়। উজ্জ্বল মল্লিক সই না করলে এবং বিষয়টি জানাজানি হলে, ২৬ নভেম্বর সংস্কার খরচ আরও ৬৯ লাখ টাকা কমিয়ে দুই কোটি ১৬ লাখ টাকায় দ্বিতীয় প্রাক্কলন অনুমোদন করা হয়। এই দরপত্রে শুধু মেসার্স নিয়াজ ট্রেডার্স অংশ নেয়। সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, মেসার্স নিয়াজ ট্রেডার্স ও ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স যৌথভাবে ৯টি অ্যাপার্টমেন্টের রূপসা ভবনের সংস্কারকাজ বাস্তবায়ন করে।
রাজউকের তদন্তে ধরা পড়লো বাংলো সংস্কারের অনিয়ম:
গত ৫ মে রাজউকের পাঁচ সদস্যের কমিটি প্রধান প্রকৌশলী (প্রকল্প ও ডিজাইন) মোবারক হোসেনের নেতৃত্বে চেয়ারম্যান বাংলো সংস্কারের কাজের অনিয়ম তদন্ত শুরু করে। এক সপ্তাহ পর, ১৩ মে, কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের বক্তব্য এবং নথি পর্যালোচনা করা হয়েছে। দেখা গেছে, বাংলোর কাজ ই-জিপিতে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে হয়েছে। দরপত্রের আগে কাজ শুরু হয়নি। তবে পাশের প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্সের কিছু শ্রমিক কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল। এরপর ২৯ জুন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় নতুন দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। যুগ্ম সচিব জহিরুল ইসলাম খানকে আহ্বায়ক ও নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ কায়সার কবিরকে সদস্য সচিব করে এই কমিটি কাজের অনিয়মের সত্যতা নিশ্চিত করে।
মন্ত্রণালয় ও রাজউকের কারসজি:
বাংলোর কাজে অনিয়ম নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি ২৭ আগস্ট গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দরপত্রের আগে কাজ শুরু এবং প্রাক্কলন অনুমোদনে সরকারি নিয়ম ভঙ্গ করা হয়েছে। এতে রাজউকের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কমিটি জড়িত তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যতে অনিয়ম রোধে পাঁচটি সুপারিশ দেয়। তবে মন্ত্রণালয় ২৫ সেপ্টেম্বরের নির্দেশনায় শুধু কাজের মান যাচাই এবং কৃচ্ছ্র নীতি অনুসরণের নির্দেশ দেয়।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক জহিরুল ইসলাম খান বলেন, “তদন্তে যা তথ্য পেয়েছি, তাই প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছি। তার ভিত্তিতেই সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। সুপারিশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব মন্ত্রণালয় ও রাজউকের।”
রাজউকের সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) ড. মো. আলম মোস্তফা বলেন, “গণপূর্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এখনও কোনো চিঠিপত্র বা নির্দেশনা আমার কাছে আসেনি।” তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়ে জানতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।

