বিগত সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে দেশের বিভিন্ন খাতের মধ্যে বিদ্যুৎ খাত ছিল সবচেয়ে বড় দুর্নীতির কেন্দ্রবিন্দু। বিশেষ আইন ব্যবহার করে এই খাতে ব্যাপক অর্থ লোপাট হয়েছে। তদন্তে দেখা গেছে, ব্যবসায়ী, আমলা থেকে শুরু করে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও এতে জড়িত।
দূর্নীতির কারণে বিদ্যুতের দাম বাজারের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। গত রোববার বিশেষজ্ঞ কমিটি এ সংক্রান্ত অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন তোলা হয়, প্রতিবেদনটি কি জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা ছিল, আদালতের রিট এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে। তবে রাজনৈতিক ও জনমত উভয় ক্ষেত্রেই দাবি উঠেছে, প্রতিবেদনটি সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশ হওয়া উচিত।
বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নের নামে এই অর্থ লোপাট হয়ে গেছে, জনগণ দীর্ঘ সময় ধরে লোকসান ভুগেছে। জনস্বার্থে জানতে চাওয়া হচ্ছে, দুর্নীতি কীভাবে হয়েছে, কোথায় গিয়েছে বিপুল অর্থ এবং কারা এই অর্থ নিয়েছে। খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, চুক্তির অনৈতিক কার্যক্রম প্রকাশের মাধ্যমে দুর্নীতির সুষ্ঠু অনুসন্ধান শুরু হওয়া উচিত।
অন্তর্বর্তী সরকারের দুই বছরের মেয়াদ শেষ হতে দুই মাসের কম সময় বাকি। এই সময়ে বিদ্যুৎ খাতের বড় অংশ দায় পরিশোধ করা হলেও ব্যয় কমানো যায়নি। খাত সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন, দেড় দশকের মধ্যে বিদ্যুৎ খাত একটি নির্দিষ্ট সিস্টেমের মধ্যেই পরিচালিত হয়েছে। বর্তমানেও সেই একই সিস্টেম চালু থাকায় দুর্নীতির পথে কেউ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না। কমিটির সদস্যরা বলেছেন, বিদ্যুৎ খাতে অনিয়ম দূর করতে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করা জরুরি। এই কমিটি প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও ব্যয় সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ সেবা নিশ্চিত করতে কাজ করবে।
দেশে গত দেড় দশকে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ানোর কথা বলে বছরের পর বছর সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। বলা হয়েছিল, বড় আকারের শিল্প-কারখানা গড়ে উঠলে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে, কিন্তু চাহিদার এ প্রক্ষেপণ কখনই বিদ্যুৎ খাতের বাস্তবতার সঙ্গে মিলেছিল না। ফল হিসেবে, চাহিদার তুলনায় কেন্দ্র প্রায়শই অব্যবহৃত থাকে। কখনও কখনও জ্বালানির ঘাটতির কারণে কেন্দ্র চালু না রেখে বসিয়ে রাখা হয় ক্যাপাসিটি চার্জ, অর্থাৎ অব্যবহৃত সক্ষমতার জন্য ভাড়া দিতে হয়।
বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নের জন্য বিশেষ আইন থাকলেও এর সুযোগকে ব্যবহার করে এ খাতে সংঘবদ্ধভাবে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে একদিকে বিদ্যুতের একক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিডি ইউডি বি) ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অন্যদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুৎ বিক্রি করে অর্থোপার্জন করেছে।
আইনের সবচেয়ে সুবিধাজনক অংশ ছিল, এই খাতে যেকোনো কার্যক্রমের বৈধতা আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যেত না। ফলে আইনের সুবিধা একমুখীভাবে খাতের উদ্যোক্তাদের পক্ষে যায়। এ আইনের আওতায় শতাধিক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে কয়েক লাখ কোটি টাকার কেনাকাটার মধ্যে অন্তত ৫০–৭০ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। অতিরিক্ত অর্থ আদায়ে চাপ পড়েছে জনগণের ওপর। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত সংস্কারের অংশ হিসেবে গত বছরের নভেম্বর মাসে বিশেষ আইনটি বাতিল করা হয়। এছাড়া, ওই আইনের আওতায় করা সব চুক্তি পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়। চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি গত রোববার এ সংক্রান্ত একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিদ্যুৎ খাতে ভয়াবহ দুর্নীতি হয়েছে। বিগত সরকারের সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রায় সাড়ে চার গুণ বেড়েছে, কিন্তু আওয়ামী লীগের দেড় দশকে ব্যয় বেড়েছে ১১ গুণ। মূল দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি। ক্রয় চুক্তির নামে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিক, আমলা ও রাজনীতিকদের যোগসাজশে বড় ধরনের লুটপাট হয়েছে। কমিটি জানিয়েছে, দুর্নীতির কারণে বিদ্যুতের দাম বাজার প্রতিযোগিতার তুলনায় ২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। বিদ্যুতের ভর্তুকি বাদ দিলে দাম ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে। এছাড়া ভারতের আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে করা চুক্তিতেও অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
কমিটি আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। তবে খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সরকারের উচিত প্রাথমিক প্রমাণের ভিত্তিতে মাঠপর্যায়ে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো। কারণ শুধু বিশেষ আইনের আওতায় চুক্তিতেই নয়, গত দেড় দশকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে নানা উপায়ে অবাধ দুর্নীতি হয়েছে। এর ভুক্তভোগী সবচেয়ে বেশি হয়েছে জনগণ। দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। খাতের অনিয়ম বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে দাম আরও বাড়ার সম্ভাবনা আছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদে ৮২টি আইপিপি (ইনডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) এবং ৩২টি কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়। এসব কেন্দ্র দেওয়া হয় বিনা টেন্ডারের মাধ্যমে। অর্থাৎ সরকার সমর্থক ব্যবসায়ী ও ব্যক্তিদের ডেকে ডেকে লাইসেন্স দেওয়া হয়। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো স্থাপনের প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ব্যয় দেখানো হয়। এসব অর্থ বিগত সরকারঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী, আমলা ও মন্ত্রীদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে। খাতের ব্যয় তোলার জন্য দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে সাধারণ মানুষ অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধে ভুগেছে, শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে এবং মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে।
উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে প্রকল্পের চুক্তি করা হলে একদিকে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হয়, অন্যদিকে লুটপাটের সুযোগও কম থাকে। বরং থাকে দায়িত্ব ও জবাবদিহি। কিন্তু বিগত দেড় দশকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ন্যায্যতা ছিল না। সরকার সমর্থিত ব্যবসায়ী ও ব্যক্তিদেরকে অর্থ লুটপাটের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, যা আড়াল করতে দায়মুক্তি আইন প্রয়োগ করা হয়েছিল। এর আগে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের লুটপাটের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। খাতের নিয়ন্ত্রণহীন দুর্নীতি রোধে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণও জরুরি।
সংঘবদ্ধ দুর্নীতির কারণে দিন দিন বিদ্যুৎ খাতটি অদক্ষ হয়ে পড়েছে। অনুৎপাদনশীল ব্যয় এখনও কমানো যায়নি। বরং বকেয়া চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে। সব মিলিয়ে, গোটা এশিয়ায় বিদ্যুৎ খাতের দক্ষতার দিক থেকে বাংলাদেশ অন্যতম পিছিয়ে পড়া দেশ। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। সরকারের উচিত দ্রুত তৎপরতা বৃদ্ধি করা এবং সমস্ত তথ্য উন্মোচন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া।

