শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ একজন সহকারী সচিব তিনি। বেতন স্কেল অনুযায়ী, তার মাসিক আয় সর্বোচ্চ ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টাকা। সেখানে তার বাৎসরিক সঞ্চয় কোনোভাবেই কোটির ঘর ছোঁয়ার কথা নয়। অথচ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মো. সেলিম শিকদারের তিনটি ব্যাংক হিসাবে মিলেছে প্রায় ১৭ কোটি টাকার রহস্যময় লেনদেন। একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে যিনি কর্মজীবন শুরু করেছিলেন, যার আয়কর বিবরণীতে বছরে মাত্র সাত থেকে ১০ লাখ টাকার আয় দেখানোর কথা, সেখানে বিপুল পরিমাণ এই অর্থের উৎস কোথায়— প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক।
সহকারী সচিব পদমর্যাদার এই কর্মকর্তার তিন ব্যাংকে জমা হওয়া অর্থের মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের হিসাবে মিলেছে ছয় কোটি ৪৫ লাখ টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকে আট কোটি ১৭ লাখ টাকা এবং সাউথইস্ট ব্যাংকে জমা হয়েছে দুই কোটি ২৮ লাখ টাকার বেশি। পরে সব টাকাই তুলে ফেলেন তিনি।
সাদা চোখে এটি অবশ্যই ঘুষ-দুর্নীতির টাকা হিসেবে বিবেচিত হবে। কারণ, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে চাকরিজীবন শুরু করা এই ব্যক্তির দেওয়া আয়কর বিবরণী বলছে, ব্যবসা ও চাকরি মিলিয়ে বছরে তার আয় সাড়ে সাত থেকে ১০ লাখ টাকা হওয়ার কথা। সেখানে ১৭ কোটি টাকার ব্যাখ্যা না থাকাই স্বাভাবিক— মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নিজ ব্যাংক হিসাবে সাড়ে ৪ লাখ টাকা থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তবে, ভিন্ন তিনটি ব্যাংক হিসাবে প্রায় ১৭ কোটি টাকা জমা হওয়ার দালিলিক প্রমাণ মিলেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ঘুষ গ্রহণ থেকে অর্জিত অর্থ এগুলো। ব্যাংকের আর্থিক বিবরণীতে দেখা গেছে, ১৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা জমা হলেও প্রায় পুরো টাকাই উত্তোলন করা হয়েছে
যদিও সেলিম শিকদারের দাখিল করা আয়কর বিবরণী ঘেঁটে কিছুটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে। ১৯৯৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনি নিজ এলাকা টাঙ্গাইলে ২৭৮ শতাংশ জমি কিনেছেন। এছাড়া, রাজধানীর মিরপুরে একাধিক প্লট ও ১১টি ফ্ল্যাটের গর্বিত মালিক হয়েছেন বলে জানা গেছে। যার বাজার মূল্য ৫০ কোটি টাকার বেশি। অর্থাৎ বিপুল পরিমাণ এই অর্থ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বা অবৈধভাবে অর্জিত। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানেও এসব অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য মিলেছে।
সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে এত সম্পদের মালিকানার প্রকৃত রহস্য উন্মোচনে তার কাছে সম্পদবিবরণী চেয়ে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেই হিসাব জমা দিতে ব্যর্থ হলেও সম্পদবিবরণী জমা দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন তিনি।
একজন সরকারি কর্মকর্তার ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক এমন লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, ‘আপনার তথ্যানুসারে, একজন সরকারি কর্মকর্তার ব্যাংক হিসাবে এমন লেনদেন অবশ্যই অস্বাভাবিক। যেহেতু দুদক তার বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে, অনুসন্ধানেই প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে। পরবর্তীতে কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বক্তব্য
এ বিষয়ে সহকারী সচিব সেলিম শিকদার বলেন, সেনপাড়া পর্বতায় অনেকে মিলে যৌথভাবে ১০ তলা ভবন নির্মাণ করেছিলাম। ওই কাজে আমি ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করি। ওই সময়ে অংশীদারদের টাকা আমার ব্যাংক হিসাবে রেখেছিলাম। সেই টাকার তথ্য পেয়েছে দুদক।

অংশীদারদের টাকা কেন আপনার ব্যক্তিগত হিসাবে লেনদেন করেছেন— এমন প্রশ্নের জবাবে সেলিম বলেন, ‘আমি আসলে তখন এটা না বুঝে করেছি। যখন বুঝতে পেরেছি তখন লেনদেন করা বাদ দিয়েছি। আসলে ওই টাকা ছিল অংশীদারদের।’
বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও প্লটসহ অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগটা ছিল বেনামি। আমি জমি ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করেছি। আমার ফ্ল্যাটগুলো যৌথভাবে কেনা জমিতে ভবন নির্মাণ সূত্রে পাওয়া। এখানে অবৈধ কোনো সম্পদের অস্তিত্ব নেই। ইতোমধ্যে আমার সম্পদের হিসাব দুদকে দাখিল করেছি। আমার অবৈধ কোনো সম্পদ নেই।’
তিন ব্যাংক হিসাবে ১৭ কোটি টাকা-
দুদকের অনুসন্ধান সূত্রে জানা গেছে, সরকারি কর্মকর্তা হয়েও মো. সেলিম শিকদারের নামে পরিচালিত তিনটি ব্যাংক হিসাবে প্রায় ১৬ কোটি ৯২ লাখ টাকার অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে। সেলিম শিকদার ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে অগ্রণী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংকে এই অর্থ লেনদেন হয়েছে।
অগ্রণী ব্যাংক পিএলসি, জাতীয় প্রেস ক্লাব শাখা: ১৯৯৬ সালের ২ নভেম্বর এই শাখায় হিসাব খোলেন সেলিম শিকদার। ২০২৪ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে নগদে ও বাহক মারফত চার লাখ, ১০ লাখ ও ২০ লাখ করে মোট ছয় কোটি ৪৫ লাখ ৫৮ হাজার ৫৫৮ টাকা জমা হয়। পরবর্তীতে পুরো টাকাই উত্তোলন করা হয়েছে।
ন্যাশনাল ব্যাংক, রোকেয়া সরণি শাখা: ২০১৫ সালের ২ আগস্ট নিজ নামে হিসাব খোলেন তিনি। ২০২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই হিসাবে আট কোটি ১৭ লাখ ৮০ হাজার ৫৫৬ টাকা জমা হয়। যার মধ্যে আট কোটি ১৭ লাখ ৬৭ হাজার ৩৩৪ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, হিসাবটি ‘অস্বাভাবিক লেনদেন’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
রাজধানী ঢাকায় স্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে— মিরপুরের সেনাপাড়া মৌজায় ৪৪ শতাংশ জমি; একই মৌজায় ১৪৪ অযুতাংশ জমির ওপর নির্মিত ভবনে তিনটি ফ্ল্যাট; ওই মৌজায় ৮৮ অযুতাংশ জমিতে একতা ভবন-১ ও ২-এ তিনটি করে মোট ছয়টি ফ্ল্যাটের মালিকানা এবং মিরপুরের অধীন মৌজা সেনপাড়া পর্বতা-২২০/৩/৯ প্লটে নির্মিত ১০ তলা ভবনে দুটি ফ্ল্যাট। এছাড়া, রয়েছে টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলায় ক্রয় করা ২০০ শতাংশের বেশি জমি এবং দুই শতাংশ জমির ওপর নির্মিত টিনশেড বাড়ি
সাউথইস্ট ব্যাংক পিএলসি: ২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিল সেলিম শিকদারের নামে হিসাব খোলা হয়। ২০২৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই কোটি ২৮ লাখ ৭৩ হাজার ২২১ টাকা জমার প্রমাণ পাওয়া গেছে। যার পুরো টাকাই উত্তোলন করা হয়েছে।
মো. সেলিম শিকদারের নামীয় তিনটি ব্যাংক হিসাবে টাঙ্গাইল, মেহেরপুর, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নগদে টাকা জমা করা হয়েছে। সবমিলিয়ে যার পরিমাণ মোট ১৬ কোটি ৯২ লাখ ১২ হাজার ৩৩৫ টাকা। জমা হওয়া টাকা পরে তুলে নেওয়া হয়েছে, যার প্রমাণ মিলেছে দুদকের অনুসন্ধানে।

একজন সরকারি চাকরিজীবী হয়ে সেলিম শিকদারের নামীয় ও নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংক হিসাবে বিপুল অঙ্কের ওই লেনদেন ‘অস্বাভাবিক ও অবৈধ’ বলে মনে করছেন ব্যাংক-সংশ্লিষ্টরা। দুদকের অনুসন্ধানকালে সেলিম শিকদার তার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ, দায়-দেনা ও অর্থের উৎস সংক্রান্ত কোনো তথ্য প্রদান করতে পারেননি বলেও দুদক সূত্রে জানা গেছে।
সেলিম শিকদারের যত সম্পদ
আয়কর নথি ও দুদকে জমা হওয়া বিভিন্ন তথ্য ও কাগজপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেলিম শিকদারের নিজ নামে এবং পরিবারের সদস্যদের নামে বিপুল পরিমাণ স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে। এসব সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে— টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলায় ক্রয় করা ২০০ শতাংশের বেশি জমি (২৩, ১৮, ৫৫.৫, ২৮, ৬, ২৮, ৯৯ ও ১৮ শতাংশ) এবং দুই শতাংশ জমির ওপর নির্মিত টিনশেড বাড়ি।
রাজধানী ঢাকায় স্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে— মিরপুরের সেনাপাড়া মৌজায় ৪৪ শতাংশ জমি; একই মৌজায় ১৪৪ অযুতাংশ জমির ওপর নির্মিত ভবনে তিনটি ফ্ল্যাট; ওই মৌজায় ৮৮ অযুতাংশ জমিতে একতা ভবন-১ ও ২-এ তিনটি করে মোট ছয়টি ফ্ল্যাটের মালিকানা এবং মিরপুরের অধীন মৌজা সেনপাড়া পর্বতা-২২০/৩/৯ প্লটে নির্মিত ১০ তলা ভবনে দুটি ফ্ল্যাট।
কাগজে-কলমে তার মোট স্থাবর সম্পদের পরিমাণ আড়াই কোটি টাকার বেশি। যদিও বাস্তবে তা প্রায় ৫০ কোটি টাকার বেশি— মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যদিও তার ব্যাংক হিসাবে উল্লেখযোগ্য টাকা পাওয়া যায়নি। আয়কর বিবরণীতে উল্লেখ করা তথ্যে, নিজ ব্যাংক হিসাবে সাড়ে ৪ লাখ টাকা থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তবে, ভিন্ন তিনটি ব্যাংক হিসাবে প্রায় ১৭ কোটি টাকা জমা হওয়ার দালিলিক প্রমাণ মিলেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ঘুষ গ্রহণ থেকে অর্জিত অর্থ এগুলো। ব্যাংকের আর্থিক বিবরণীতে দেখা গেছে, ১৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা জমা হলেও প্রায় পুরো টাকাই উত্তোলন করা হয়েছে।
নিম্নমান সহকারী থেকে সহকারী সচিব
সেলিম শিকদার ১৯৯২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর নিম্নমান সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক (সাধারণ শাখা) পদে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। ২০০৩ সালের জুলাই মাসে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। তিনি কো-অর্ডিনেশন শাখা, বহির্বিশ্বের বৃত্তি শাখা এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখায়ও কর্মরত ছিলেন।
২০১৯ সালে প্রশাসনিক পদ থেকে সহকারী সচিব পদে পদোন্নতি লাভ করেন। প্রথমে আইন শাখা এবং পরে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা শাখায় যোগ দেন। বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের নিরীক্ষা ও আইন বিভাগে কর্মরত তিনি। বেতন স্কেল সপ্তম গ্রেডে। স্ত্রীর নাম শাহনাজ আক্তার, তিনি অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক।
দুদকের অনুসন্ধানের শুরুতে সেলিম শিকদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি এমপিওভুক্ত করার নামে লাখ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। যার মাধ্যমে রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় তিনটি ফ্ল্যাট, দক্ষিণ পীরেরবাগে ১১টি ফ্ল্যাটের মালিকানাসহ বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন।
ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদন

