বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানি হোসাফ পাওয়ারের ৪৮৪ কোটি টাকা ঋণের তথ্য ইসলামী ব্যাংক আড়াল করেছে। ব্যাংক এই ঋণ নিয়মিত দেখিয়েছে না কিন্তু নতুন করে ৯৬ কোটি টাকার এলসি সুবিধা নিতে গেলে বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে আসে।
ইসলামী ব্যাংকে হোসাফ পাওয়ারের চলতি মূলধন ঋণ এক হাজার ১৬৩ কোটি টাকা। তবে ব্যাংক গত বছর থেকে তা ৬৭৯ কোটি টাকাই দেখাচ্ছিল। বিষয়টি ধরা পড়লে বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে। একই সঙ্গে এসব ঋণ খেলাপি হিসেবে দেখানোর নির্দেশ দিয়েছে। এই অনিয়ম ঘটেছে ইসলামী ব্যাংকের মৌচাক শাখায়, যা হোসাফ গ্রুপের মালিকানাধীন ভবনে অবস্থিত।
চলতি মূলধনের বাইরে, ইসলামী ব্যাংকের নেতৃত্বে হোসাফ পাওয়ারকে চারটি ব্যাংক ৬৭১ কোটি টাকার প্রকল্প ঋণ দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এই ঋণেও অনিয়ম পেয়েছে। সব মিলিয়ে হোসাফ পাওয়ারের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকে এককভাবে ঋণ দাঁড়ায় এক হাজার ৫৩১ কোটি টাকা। এটি একক গ্রাহকের ঋণসীমার লঙ্ঘন। কারণ, একটি ব্যাংক কোনো একক গ্রাহককে তার মোট মূলধনের সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ সরাসরি (ফান্ডেড) ঋণ দিতে পারে।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ইসলামী ব্যাংকে হোসাফ গ্রুপের মালিকানাধীন হোসাফ পাওয়ারের চলতি মূলধনের ঋণসীমা ৮০০ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে সিন্ডিকেশন ফাইন্যান্সিংয়ের আওতায় ইসলামী ব্যাংকের নেতৃত্বে চারটি ব্যাংক হোসাফ পাওয়ারকে প্রকল্প ঋণ দিয়েছে। এই ঋণের স্থিতি বর্তমানে ৬৭১ কোটি টাকা, যা আগেই খেলাপি হয়েছে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক পাবেন ৩৬৮ কোটি টাকা। অন্য তিন ব্যাংকের মধ্যে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পাবেন ১৩৫ কোটি, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ১১০ কোটি এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৫৭ কোটি টাকা। ইসলামী ব্যাংকের এই ঋণ বিতরণের ফলে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত সরকারের সময়ে বড় অঙ্কের জালিয়াতির কারণে ব্যাংকের এই দুর্বল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
গত ২২ এপ্রিল মতিঝিলে চারটি ব্যাংক ও হোসাফ পাওয়ারের প্রতিনিধিদের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে হোসাফ পাওয়ার জানিয়েছে, ডলারের দর অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া, বিনিময় হারে লোকসান, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) থেকে বকেয়া আদায় না হওয়া, কভিড-১৯ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে ঋণ খেলাপি হয়েছে। কোম্পানি বলেছে, ঋণ পুনঃতপশিল করলে প্রকল্প ভালোভাবে চালানো সম্ভব। ব্যাংকগুলো ছয় বছরের জন্য ১০ শতাংশ এককালীন ডাউন পেমেন্টের বিনিময়ে পুনঃতপশিলের জন্য সম্মত হয়। তবে হোসাফ পাওয়ার এখনও এই ডাউন পেমেন্ট জমা দেয়নি।
সূত্র জানায়, যে প্রক্রিয়ায় ঋণ দেওয়া হয়েছে, তাতে এটি খেলাপি হওয়ার কথা ছিল না। হোসাফ গ্রুপের পরিচালক মাবরুর হোসেন জানিয়েছেন, সরকারের কাছ থেকে সময়মতো বিল না পাওয়ায় ঋণ পরিশোধে সমস্যা হয়েছে। তারা আশা করছেন, চলতি মাসের মধ্যে বিল পাওয়ার পর ঋণগুলো নিয়মিত হয়ে যাবে।
সিন্ডিকেশন ঋণের চুক্তি অনুযায়ী, সরকারের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রির টাকা ইসলামী ব্যাংকের মৌচাক শাখায় ‘এসক্রো’ হিসাবের মাধ্যমে জমা হয়। এই হিসাব থেকে সব ব্যাংকের ঋণের কিস্তি সমন্বয় করা হয়। এরপর অতিরিক্ত অর্থ থাকলে তা গ্রাহক বা ঋণগ্রহীতা পান। তবে ইসলামী ব্যাংক এই শর্ত ভঙ্গ করে হোসাফ পাওয়ারকে সরকার থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুৎ বিক্রির বিলের অর্থ নগদে তুলে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে। ফলে ঋণ সমন্বয় না হওয়ায় তা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে হোসাফ পাওয়ার জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনীতে প্রকল্পটি স্থাপন করা হয়েছে। ১৫ বছরের জন্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি রয়েছে।
ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক খান জানান, হোসাফ পাওয়ারের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাখ্যা চাওয়ার বিষয়টি তিনি জানেন। তবে পুরো অবস্থা বুঝে পরে মন্তব্য করবেন। ইসলামী ব্যাংকে হোসাফ পাওয়ারের খেলাপি ঋণ ও সীমাতিরিক্ত বিনিয়োগ দীর্ঘ সময় আড়ালে ছিল। চলতি বছরের ১৫ মে, হোসাফ পাওয়ারের ৭৯ লাখ ডলারের নতুন এলসি খোলার জন্য ব্যাংক তথ্য আপলোড করলে বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরে আসে। যাচাই করতে গিয়ে দেখা যায়, আগে খোলা কয়েকটি এলসির বিপরীতে হোসাফ পাওয়ার ৪৮৪ কোটি টাকা পরিশোধ করেনি। অথচ ব্যাংক এক বছর আগে হোসাফের বিদেশি সরবরাহকারীকে অর্থ পরিশোধ করে দিয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংক এলসির দায় পরিশোধের পর এই ৪৮৪ কোটি টাকা হোসাফ পাওয়ারের নামে ‘ফোর্সড লোন’ হিসেবে প্রদর্শন করতে হতো। কিন্তু ইসলামী ব্যাংক তা ‘ইন্টার ব্যাংক ডেবিট অ্যাডভাইস (আইবিডিএ)’ হিসেবে আলাদা রেখেছে। ফলে ঋণ সিআইবিতে প্রতিফলিত হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসলামী ব্যাংকে হোসাফ পাওয়ারের অনুমোদিত ঋণসীমা ৮০০ কোটি টাকা। তথ্য গোপন না করলে চলতি মূলধনসহ ঋণ দাঁড়াত এক হাজার ১৬৩ কোটি টাকা। এটি সীমার চেয়ে ৩৬৩ কোটি টাকা বেশি। সীমাতিরিক্ত ঋণ সমন্বয় না করে আগের দায় নবায়নের সুযোগ ছিল না। তথ্য গোপনের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক গ্রাহককে অনৈতিক সুবিধা দিয়েছে। ফলে ব্যাংক হোসাফ পাওয়ারের ঋণ ৬৭৯ কোটি টাকা দেখিয়েছে, যাতে এটি অনুমোদিত সীমার নিচে থাকে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গোপন করা ঋণের বড় অংশ আগেই খেলাপি হয়ে গেছে। এর মধ্যে:
- ২০২৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি খোলা ১০টি এলসির বিপরীতে ১১৯ কোটি টাকা
- ২০২৪ সালের ৩০ এপ্রিল খোলা ৩টি এলসির বিপরীতে ৫১ কোটি টাকা
- ২০২৪ সালের ২৩ অক্টোবর খোলা ১২টি এলসির বিপরীতে ১০৫ কোটি টাকা ‘সন্দেহজনক’ মানের খেলাপি
- বাকি ২০৯ কোটি টাকা সাধারণ খেলাপি
ইসলামী ব্যাংকের মৌচাক শাখার ব্যবস্থাপক মো. আশরাফ আলী বলেন, ঋণের তথ্য গোপন করে হোসাফ পাওয়ারকে সীমাতিরিক্ত সুবিধা দেওয়া হয়নি। আগের দায় পরিশোধ না করা পর্যন্ত নতুন কোনো সুবিধা দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাখ্যা ইতিমধ্যেই পাঠানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হোসাফ পাওয়ার থেকে পিডিবি-র মাধ্যমে পাওয়া বিদ্যুৎ বিক্রির অর্থ দিয়ে সব ব্যাংকের ঋণ কিস্তি পরিশোধের কথা ছিল। কিন্তু ইসলামী ব্যাংক সিন্ডিকেশন অর্থায়নের শর্ত ভঙ্গ করে হোসাফ পাওয়ারকে টাকা তুলে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, ইসলামী ব্যাংক যদি অর্থ উত্তোলনের সুযোগ না দিত, গ্রাহক কোনোভাবে তা উত্তোলন করতে পারত না। বাংলাদেশ ব্যাংক এই অনিয়ম খতিয়ে দেখে ইসলামী ব্যাংকের মৌচাক শাখা এবং প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়দায়িত্ব চিহ্নিত করার জন্য বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন বিভাগকে দায়িত্ব দিয়েছে।
ইসলামী ব্যাংকের মৌচাক শাখার ব্যবস্থাপক বলেন, ঋণ সমন্বয় না করে সরকারি বিলের টাকা উত্তোলনের সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি ঠিক হয়নি। তবে সরকারকে শুল্ক পরিশোধের জন্য গ্রাহককে কিছু অর্থ উত্তোলনের সুযোগ দেওয়া হয়। তিনি জানান, সরকারের কাছে হোসাফ পাওয়ার ৪০০ কোটি টাকার বেশি পাওনা আছে। এই অর্থ গেলে সিন্ডিকেশনে থাকা ব্যাংকগুলোর কিস্তি পরিশোধ হবে। পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকের ‘আইবিডিএ’ দায়ও অনেকাংশে সমন্বয় হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান জানান, ইসলামী ব্যাংকের ব্যাখ্যা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনের আলোকে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
হোসাফ পাওয়ার জানিয়েছে, তারা সরকারের কাছ থেকে বিদ্যুৎ বিক্রির টাকা পেলে ঋণ পরিশোধ করবে। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলোর মোট ১,৮৩৪ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে সরকারের কাছে হোসাফ পাওনা খুব বেশি নয়। বর্তমানে তারা সরকারের কাছ থেকে পাবে মাত্র ২৪০ কোটি টাকা। এর বাইরে হোসাফ পাওয়ার বৈদেশিক মুদ্রার দর ওঠানামাজনিত লোকসানের জন্য আরও প্রায় ২২৪ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ডলারের ওঠানামাজনিত লোকসানের বিপরীতে সরকার কোনো ক্ষতিপূরণ দেবে না।
তবে এই ধরনের ঋণ পরিশোধে সময় বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছরের ২৭ নভেম্বর একটি সার্কুলার জারি করেছিল। এতে বলা হয়, বিনিময় হারজনিত কারণে ক্ষতির মুখে পড়া গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ সর্বোচ্চ আট বছর পর্যন্ত সময় দেওয়া যাবে। তবে এই সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে একক গ্রাহকের ঋণসীমা অতিক্রম করা যাবে না। এছাড়া কোনো ঋণখেলাপি গ্রাহককে এ সুবিধা দেওয়া যাবে না। ফলে হোসাফ পাওয়ারের বৈদেশিক মুদ্রা লোকসানের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগ নেই।

