এখন কেবল ১ হাজার বা ৫০০ টাকার নোটই নয়, ৫০, ১০০ এমনকি ২০ টাকার নোটও জাল হচ্ছে। নতুন ডিজাইনের নোটগুলোও জালকারী চক্রের দখলে পড়েছে। নিরাপত্তা সুতা থেকে শুরু করে নোটের সব বৈশিষ্ট্যই এত সূক্ষ্মভাবে অনুকরণ করা হচ্ছে, যে অনেক সময় ব্যাংকের কর্মীরাও সনাক্ত করতে হিমশিম খাচ্ছেন।
জাল নোটের এই অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে নিয়ে বিশেষ বৈঠক করেছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংককে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সংক্রান্ত সতর্কতামূলক নোটিশও তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যক্তিগত লেনদেন থেকে শুরু করে ব্যাংক লেনদেন ও ছোট-বড় কেনাকাটায় খুব কৌশলে জাল নোট বাজারে প্রবেশ করানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বেশ কিছু জাল নোট জব্দ করেছে।
গত মাসে প্রবাসী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের তার ফেসবুকে উল্লেখ করেন, দেশের অর্থনীতিতে বিরাট অঙ্কের জাল নোট প্রবেশ করছে। তিনি লেখেন, ‘বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার লক্ষ্যে পার্শ্ববর্তী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায় প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণ জাল নোট দেশে আনা হচ্ছে।’ যদিও এই তথ্যের সত্যতা এখনো নিশ্চিত হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তৃপক্ষ বিষয়টি যাচাই করছেন। তবে বাজারে বিভিন্ন সংখ্যক জাল নোট বিচ্ছিন্নভাবে জব্দ হওয়া সত্যি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানিয়েছেন, ‘জাল নোটের ব্যবহার ও চক্রের কার্যক্রম নজরে আসায় কয়েক দিন আগে ডেপুটি গভর্নর জাকির হোসেন চৌধুরী’র সভাপতিত্বে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে বলা হয়েছে, কোনোভাবেই অর্থনীতিতে জাল নোট প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না এবং সবাইকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে জানা গেছে, রাজধানীর পান্থপথে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের একটি শাখায় গত রবিবার সকালে পশ্চিম রাজাবাজারের একটি আবাসিক ভবনের তত্ত্বাবধায়ক মনসুর আলী (ছদ্মনাম) ৫০ হাজার টাকা জমা দেন। ভাড়াটেদের কাছ থেকে পাওয়া টাকাগুলো তিনি প্রবাসী ভবনমালিকের অ্যাকাউন্টে জমা দেন এবং বাসায় ফেরেন। ঘণ্টা দেড়েক পর ব্যাংক থেকে ফোন আসে, যে তার জমা করা টাকার মধ্যে ১ হাজার টাকার একটি নোট জাল।
মনসুর আলী বলেন, ‘জীবনে প্রথম এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হয়েছি। ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টারে জমা দেওয়ার সময় নারী কর্মকর্তার কাছে কোনো কিছু বলা হয়নি। তারা অভিজ্ঞ এবং জাল নোট শনাক্তের মেশিন রয়েছে। ধরা পড়েনি, কিন্তু দেড় ঘণ্টা পর ফোনে জানানো হলো। শেষ পর্যন্ত পকেট থেকে ওই কর্মকর্তাকে ১ হাজার টাকা দিয়ে চলে আসি।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাধারণত দুই ঈদ, দুর্গাপূজা, বর্ষবরণসহ উৎসবে জাল নোট চক্রের তৎপরতা বাড়ে। কারণ ওই সময় অর্থনৈতিক লেনদেন অনেক বৃদ্ধি পায়। তবে বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, কোনো উৎসবের প্রয়োজন নেই, প্রায় সব সময়ই চক্রগুলোর কার্যক্রম সক্রিয়।
বাংলাদেশে জাল নোটের তৎপরতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। কর্মকর্তারা বলছেন, নোট জাল করার এই অপরাধটি সরাসরি দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার উপর নির্ভরশীল। যারা মাঝে মাঝে গ্রেপ্তার হচ্ছেন, জিজ্ঞাসাবাদের পর জানা যাচ্ছে, তারা আগেও একই ধরনের অপরাধে জড়িত ছিলেন। অর্থাৎ অভিজ্ঞ চক্রের সদস্যরা বারবার গ্রেপ্তার হলেও অল্প দিনেই জামিনে মুক্তি পেয়ে ফের একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন।
তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, দুর্গাপূজার সময় ২৭ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার দুর্গামন্দির এলাকা থেকে প্রায় দেড় লাখ টাকার সমমূল্যের জাল নোটসহ জীবন আহমেদ পলাশ নামে একজনকে আটক করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, পলাশ আগেও জাল টাকাসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। জব্দকৃত নোটগুলো ১ হাজার টাকার, যার মধ্যে নতুন ডিজাইনের নোটও ছিল।
এর আগে ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট নুরনগর হাউজিং সোসাইটির একটি ফ্ল্যাট থেকে ২০ কোটি টাকার সমমূল্যের দেশি-বিদেশি জাল নোটসহ তানজিম (২০) নামে এক তরুণকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-৭। র্যাব জানায়, অনলাইনের মাধ্যমে এসব জাল টাকা বিক্রি করা হতো। এ ছাড়া ৫ আগস্ট মিরপুর এলাকা থেকে জাল নোট ও প্রিন্টারসহ মো. মিজানুর রহমান ওরফে মিলন (২৬) নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। মিরপুর মডেল থানা পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তারকৃত যুবকের কাছ থেকে ১ হাজার টাকার ১৪টি, ১০০ টাকার ১৮টি ও ২০ টাকার ৬টি জাল নোট উদ্ধার করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় এমন আরও বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এইচ এম শাহাদাত হোসাইন জানিয়েছেন, জাল নোট চক্রের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন ইউনিট সব সময় সতর্কভাবে কাজ করছে। মাঝেমধ্যেই জাল নোটসহ চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তবে বিশেষ নজরদারি চালাচ্ছে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সিআইডি, যা জাল নোটের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে।
সিআইডির গণমাধ্যম শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন খান বলেন, ‘বর্তমানে জাল নোট তৈরিকারীদের তৎপরতা বেড়ে গেছে। আমাদের গোয়েন্দারা চিহ্নিত কিছু চক্রের কার্যক্রমের দিকে সব সময় নজর রাখছেন। সাধারণ জনগণের প্রতি আহ্বান, এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ বা সন্দেহ হলে আমাদের জানান।’
বাংলাদেশে জাল নোটের চক্র ক্রমেই সক্রিয় হচ্ছে। সিআইডির মুখপাত্র জসীম উদ্দিন খান জনসচেতনতার গুরুত্বের প্রতি জোর দিয়ে বলেন, ‘যার কাছে জাল নোট পাওয়া যায়, প্রাথমিকভাবে তাকে দায়ী বিবেচনা করা হয়। এই অপরাধে দণ্ডবিধির ৪৮৯ ধারা ও বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রযোজ্য। এসব মামলায় ১০ বছরের কারাদণ্ড থেকে শুরু করে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। তাই প্রত্যেক নাগরিকের সচেতন ও সতর্ক থাকা অত্যন্ত জরুরি।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, জাল নোট প্রতিরোধে সব পর্যায়ে কাজ চলছে। বিষয়গুলো সমন্বয়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ চালু করা হয়েছে। গ্রুপে ডিপার্টমেন্ট অব কারেন্সি ম্যানেজমেন্টের প্রতিনিধিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যুক্ত থাকবেন। এতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত জাল নোট সংক্রান্ত যেকোনো প্রতিবেদন—সত্য হোক বা না হোক—শেয়ার করা হবে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। এছাড়া গোয়েন্দা নজরদারি ও জনসচেতনতা মূলক কার্যক্রমও কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালনা করছে।
গত ১৯ অক্টোবর ব্র্যাক ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের উদ্দেশে সচেতনতামূলক নোটিশ জারি করেছে। নোটিশে বলা হয়েছে, ‘দেশে জাল টাকার অনুপ্রবেশের বিষয়টি মাথায় রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ লেনদেনে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছে। নগদ গ্রহণের সময় জলছাপ, অসমতল ছাপা, নিরাপত্তা সুতা, রং পরিবর্তনশীল কালি ও ক্ষুদ্র লেখা যাচাই করুন। সন্দেহজনক নোট দেখা দিলে নিকটস্থ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে অবহিত করুন।’
জাল নোটের চক্র কেবল অভিজ্ঞ ও দক্ষ অপরাধীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি সাধারণ নাগরিকের সচেতনতা ও দায়িত্বের উপরও নির্ভর করছে। সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ—ব্যাংক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সিআইডির যৌথ নজরদারি—নিরাপত্তা বাড়িয়েছে। তবে সাধারণ মানুষকে সতর্ক না করলে এই চক্রের প্রভাব সীমিত করা কঠিন। তাই প্রতিটি নগদ লেনদেনেই সচেতন থাকা জরুরি, কারণ একটিও জাল নোট অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে।

