দেশের প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের বিমান পরিবহন খাত এখন মারাত্মক অস্থিরতায়। কিছু অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি (ওটিএ) গ্রাহক ও ছোট-মাঝারি এজেন্টদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নজরদারির অভাব ও দীর্ঘদিনের উদাসীনতা এই বিশৃঙ্খলার মূল কারণ।
গত দুই মাসে অন্তত তিনটি ওটিএ বাজার থেকে উধাও হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তারা গ্রাহক ও ট্রাভেল এজেন্টদের কাছ থেকে অগ্রিম শত শত কোটি টাকা নিয়েছে। অনেক যাত্রী আকর্ষণীয় ছাড় ও অগ্রিম টিকিট অফারে ফেঁসে প্রতারিত হয়েছেন। পরে দেখা গেছে, এসব অফারের বেশির ভাগই ভুয়া বা প্রতারণামূলক।
শুধু অনলাইন নয়, দীর্ঘদিনের কিছু প্রতিষ্ঠিত ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ উঠেছে। খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, ওটিএ নিয়ন্ত্রণে নীতিমালার অভাব এবং শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় এ ধরনের প্রতারণা বারবার ঘটছে।
ফ্লাই ফার ইন্টারন্যাশনাল কেলেঙ্কারির এক সপ্তাহের মধ্যেই অক্টোবর মাসে “ট্রাভেল বিজনেস পোর্টাল” বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠানটি শত শত গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে। আগের আগস্টে ফ্লাইট এক্সপার্টের মালিকরাও একইভাবে গ্রাহক অর্থ নিয়ে দেশ ত্যাগ করেন। এই দুই মাসে এটিই তৃতীয় বড় ওটিএ কেলেঙ্কারি।
এ ঘটনায় একাধিক ট্রাভেল এজেন্ট থানায় মামলা ও অভিযোগ করেছেন। তবে এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর আগে ২৪টিকিট ডটকম, ফ্লাইটবুকিং ডটকমসহ আরও কয়েকটি কোম্পানির বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ উঠেছিল, যা এখনো সমাধান হয়নি।
অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) মহাসচিব আসফিয়া জান্নাত সালেহ বলেন, “অতিরিক্ত মূল্য ছাড়, এডভান্স পেমেন্ট কালেকশন, ক্যাশব্যাক প্রভৃতি প্রলোভন দেখিয়ে অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সিগুলো বিপুল টাকা হাতিয়ে নেয়। এরপর হঠাৎ করে উধাও হয়ে যায়। আমরা একাধিকবার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। কার্যকর ব্যবস্থা নিলে বারবার প্রতারণা হতো না।”
সরকারও অবশেষে পদক্ষেপ নিয়েছে। ট্রাভেল এজেন্সি নিয়ন্ত্রণ ও নিবন্ধন আইন সংশোধন করে খসড়া অধ্যাদেশ প্রকাশ করা হয়েছে। এতে প্রস্তাব করা হয়েছে— অনলাইন এজেন্সির জন্য ১ কোটি ও অফলাইন এজেন্সির জন্য ১০ লাখ টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি বাধ্যতামূলক করা। এছাড়া কোনো এজেন্সি আরেকটির কাছে বি-টু-বি বিক্রি করতে পারবে না।
ট্রাভেল বিজনেস পোর্টাল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনজুরুল আলম ও জেনারেল ম্যানেজার ইমন আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে কোম্পানির এক কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, গ্রাহকদের কাছে প্রায় ২৮ কোটি টাকা দেনা রয়েছে। তিনি বলেন, “আমরাও জানি না মালিকরা কীভাবে উধাও হলেন। এখন আমাদের ভবিষ্যৎ ও নিরাপত্তা নিয়েই উদ্বিগ্ন।”
বাংলাদেশে অনুমোদনপ্রাপ্ত ট্রাভেল এজেন্সির সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। তবে পূর্ণ কার্যক্রমের জন্য আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সংস্থা (আইএটিএ) থেকে অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক। দেশের প্রায় ১৩০০ এজেন্সি আইএটিএ অনুমোদিত কিন্তু সক্রিয়ভাবে টিকিট বিক্রি করে মাত্র ৭০০–৭৫০টি। বাকিগুলো সাব-এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে।
মাসিক এয়ার টিকিট বিক্রির বাজার প্রায় ১২০০–১৩০০ কোটি টাকা। বছরে এটি এক বিলিয়ন ডলারের বেশি। অনলাইনে সরাসরি টিকিট কাটা মানুষের হার ১০–১২ শতাংশের বেশি নয়। বর্তমানে ১২–১৫টি ওটিএ সক্রিয়, যেখানে শেয়ারট্রিপ ও গোজায়ন শীর্ষে।
শীর্ষস্থানীয় ওটিএ’র একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, বন্ধ হওয়া তিনটি অনলাইন এজেন্সির কেউই সরাসরি এয়ারলাইনের কাছ থেকে টিকিট কিনত না। তারা বড় এজেন্টদের কাছ থেকে ক্রেডিটে টিকিট নিত। এই বড় এজেন্টরাও কোনো সিকিউরিটি বা ব্যাংক গ্যারান্টি না নিয়ে কোটি কোটি টাকার টিকিট দিয়েছে।
হাজী এয়ার ট্রাভেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নির্মল চন্দ্র বৈরাগী অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমরাই বরং ক্ষতির শিকার। আমরা ফ্লাইট এক্সপার্টের কাছে ৩০ কোটি, ফ্লাই ফারের কাছে ৮ কোটি, ট্রাভেল বিজনেস অনলাইনের কাছে ২ কোটি টাকার বেশি হারিয়েছি।”
সংশ্লিষ্টরা সামাজিক মাধ্যমে পোস্টে অভিযোগ করেছেন, জামানতহীন বা অনিরাপদ টিকিট বিক্রি ট্যাক্স ফাঁকি বা অর্থ পাচারের হাতিয়ার হতে পারে।
ফ্লাইট এক্সপার্টের কর্মকর্তারা দেশ ত্যাগের পর আটাব তাদের সদস্যপদ স্থগিত করে। আটাব জানায়, অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সিগুলো প্রতি টিকিটে ৩০০০–৫০০০ টাকা অবাস্তব ছাড় দিয়ে বাজারকে অস্থিতিশীল করছে।
সম্প্রতি মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিদপ্তরের সহযোগিতায় অভিযান চালানো হচ্ছে। তবে খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কার্যকর পদক্ষেপের অভাব স্পষ্ট।
খাত বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন, অনলাইন বা অচেনা এজেন্সির মাধ্যমে টিকিট কেনার সময় সতর্ক থাকতে। গ্রাহকদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ উপায় হলো ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডে পেমেন্ট করা। এতে ১৮০ দিনের মধ্যে সমস্যা হলে টাকা ফেরত পাওয়া যায়। সাব-এজেন্টদের উচিত ক্রেডিট নেওয়ার আগে সিকিউরিটি বা ব্যাংক গ্যারান্টি নিশ্চিত করা।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মুখপাত্র কামরুল ইসলাম বলেন, “ঘন ঘন প্রতারণা ঘটছে। গ্রাহকরা সরাসরি এয়ারলাইন থেকে টিকিট কিনুক। না হলে মন্ত্রণালয়কে বি-টু-বি বিক্রি বন্ধ করতে হবে।”

