দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম বন্দরে উপ-সংরক্ষক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন ক্যাপ্টেন ফরিদুল আলম। দায়িত্বে থাকাকালীন সময় থেকেই তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ রয়েছে—পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেওয়া, দায়িত্বে অবহেলা, বাইরের লোকজন দিয়ে কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি এবং অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের মতো কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন তিনি।
এইসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক মাস আগে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় তাকে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পায়রা বন্দরে বদলি করে। বর্তমানে তিনি সেখানে পরিচালক (ট্রাফিক) হিসেবে কর্মরত।
সম্প্রতি প্রায় ৪ কোটি টাকার বিল তোলার চেষ্টা নিয়ে ফের আলোচনায় আসেন ক্যাপ্টেন ফরিদ। তদন্তে নতুন করে তার অনিয়মের চিত্র উঠে আসে। অভিযোগ রয়েছে—চট্টগ্রাম বন্দরে ফেরার জন্যও তিনি তদবির চালাচ্ছেন এবং এখনও বিভিন্নভাবে প্রভাব খাটিয়ে পরিচিতজনদের সুবিধা পাইয়ে দিচ্ছেন।
চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তারা জানান, ফরিদুল আলমকে নিয়ে তারা বিব্রত। একাধিক চিঠির পর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় গত ২৯ এপ্রিল তাকে পায়রা বন্দরে বদলি করে। তবে বদলির পরও তার ঘনিষ্ঠদের অন্য বিভাগে সরিয়ে দিতে হয় বন্দর কর্তৃপক্ষকে।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো দুটি গোপনীয় চিঠি হাতে এসেছে। প্রথম চিঠি পাঠানো হয় গত ১৮ মার্চ, দ্বিতীয়টি ২৭ এপ্রিল। বন্দরের সচিব ওমর ফারুক স্বাক্ষরিত এই চিঠিতেই ফরিদুল আলমের বিরুদ্ধে বিস্তারিত অভিযোগ তোলা হয়।
চিঠিতে বলা হয়, ক্যাপ্টেন ফরিদ টাগবোট এমটি কাণ্ডারি–৮-এর ডকিং, পাইপিং, আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ক, পেইন্টিং এবং যন্ত্রপাতি মেরামতের টেন্ডারে অনিয়ম করেন। তিনি সর্বনিম্ন দরদাতাকে বাদ দিয়ে অন্য ঠিকাদার মেসার্স মাহি এন্টারপ্রাইজকে কাজ দেন।
২০২৪ সালের ২২ ডিসেম্বর কার্যাদেশ দেওয়া হয়, এবং মাত্র আট দিনের মধ্যে কাজ শেষ হয়েছে বলে রিপোর্ট দিয়ে ৪ কোটি ৮১ লাখ টাকার বিল পরিশোধের তাগাদা দেন। এতে প্রশ্ন ওঠে, এত বড় কাজ কীভাবে এত অল্প সময়ে শেষ হলো?
বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্তে অনিয়মের প্রমাণ মেলে। এরপর ২৭ এপ্রিলের চিঠিতে ক্যাপ্টেন ফরিদকে অন্যত্র বদলির সুপারিশ করা হয়।
চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে, উপ-সংরক্ষক পদে পদোন্নতির পর থেকেই তিনি বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। টাগবোট কাণ্ডারি–৮–এর কাজ ছাড়াও ২০১১ সালের ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ভিটিএমএস) প্রকল্পে তিনি অনুমোদন ছাড়াই ২ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে প্রাক্কলন তৈরি করেন এবং কাজ শেষ হওয়ার আগেই বিল পরিশোধ করেন।
এছাড়া ২০১৩ সালে এমভি গ্লেডিস নামের একটি ইন্দোনেশিয়ান জাহাজকে একক সিদ্ধান্তে বন্দরে ভিড়ানোর নির্দেশ দিয়ে সেটি গ্রাউন্ডেড করেন। তদন্ত কমিটি তখন তাকে দায়ী করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে। পরবর্তীতে তাকে এক বছর সাময়িক বরখাস্তও করা হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চিঠিতে আরও বলা হয়, ফরিদুল আলম বিভিন্ন সময়ে বাইরের ব্যক্তিদের ব্যবহার করে কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। সম্প্রতি নিজেকে সদস্য (অর্থ) হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্যও নানা তদবির চালিয়েছেন, যা বন্দরের কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, “পদোন্নতির বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের। তারা আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবেন। টাগবোটের বিষয়েও আমরা শুধু কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুসরণ করেছি।”
তিনি দুর্নীতির বিষয়ে বিস্তারিত মন্তব্য করতে চাননি।
অন্যদিকে ক্যাপ্টেন ফরিদুল আলম বলেন, “সব কাজ যথাযথ প্রক্রিয়ায় হয়েছে। কোনো কিছুই আমার একক সিদ্ধান্তে নয়।”
তবে কীভাবে আট দিনের মধ্যে কাজ শেষ হলো—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দরের ৯০ শতাংশ কাজই এমনভাবে হয়। তদন্ত কমিটি আমার বিরুদ্ধে কিছুই পায়নি।”
তাকে বদলির কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি মন্ত্রণালয়কে জবাব দিয়েছি। কেন আমাকে জড়ানো হচ্ছে জানি না। প্রমোশন চাইলে সেটা অপরাধ নয়।”
বাইরের ব্যক্তি দিয়ে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন।
চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তাদের প্রশ্ন—বহুবার দুর্নীতির অভিযোগ ও তদন্ত সত্ত্বেও কীভাবে এখনো বহাল তবিয়তে আছেন ক্যাপ্টেন ফরিদুল আলম?
সূত্র- দ্য ডেইলি স্টার

