শেখ হাসিনার শাসনামলে গুমকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বিরোধী মত দমন করে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। গুমের শিকার ব্যক্তিদের ও তাদের পরিবারের কোনো প্রতিকার বা সহায়তার ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
হাসিনা সরকারের বিদায়ের পরও একই কারণে গুমের শিকারদের প্রতিকার সম্ভব হয়নি। ঘটনার প্রকৃত দায়িত্ব ও দায়সারিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই পরিস্থিতি সমাজে দীর্ঘস্থায়ী অনিশ্চয়তা ও ন্যায্য বিচারের অভাব সৃষ্টি করেছে। গুম এবং বিরোধী দমন কৌশল শুধুমাত্র ব্যক্তিগত স্বার্থ ও ক্ষমতা রক্ষার একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়েছে, যার ফলে সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছে।
উপদেষ্টা পরিষদ গুমের বিচারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যাদেশ অনুমোদন করেছে। এই অধ্যাদেশে গুমের অপরাধের ধরন ও আওতা চিহ্নিত করা হয়েছে এবং শাস্তির বিধান নির্ধারণ করা হয়েছে। পতিত হাসিনা সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্য পূর্বে আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে ক্রমাগত এই ভয়াবহ অপরাধ ঘটাতেন। তারা আইনের স্পষ্ট বিধান না থাকার সুযোগ নিয়ে গুম করে পার পেতেন।
ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার গুমসংক্রান্ত এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইনের দুর্বলতা বন্ধ করেছে। ভবিষ্যতে যদি রাজনৈতিক সরকার আন্তরিকভাবে এটি বাস্তবায়ন করে, গুম করেও কেউ পিছু বাঁচতে পারবে না। এ অধ্যাদেশের নাম দেওয়া হয়েছে ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ-২০২৫’। সংবিধানে নির্ধারিত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার রক্ষাই এই আইনের মূল লক্ষ্য। আইনটি গুমসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশন, যা বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রণীত হয়েছে। অভিযোগপত্র দায়েরের ১২০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করতে হবে। সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে রাখা হয়েছে মৃত্যুদণ্ড এবং এক কোটি টাকা জরিমানা।
আগে গুম করা অপরাধ হিসেবে গণ্য হতো না। সরকার গুমের শিকার ব্যক্তিদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলত। স্বজনদের জানার অধিকার খর্ব করা হতো। যারা গুম করতেন, হাসিনা তাদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দিয়ে রেখেছিলেন। গুমের শিকার ব্যক্তিকে হত্যা করা, যেকোনো ধরনের শাস্তি দেয়া বা আটক রাখার অধিকার তারা সংরক্ষণ করতেন। গত দেড় দশকে একজন অভিযুক্তকেও শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি। বরং যারা এই নিষ্ঠুরতা করত, তাদের দ্রুত পদোন্নতি দেয়া হতো। গুমের ভয়ে মানুষের সম্পদও কেড়ে নেয়া হতো।
নতুন আইনে গুমসংক্রান্ত অপরাধ সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। উচ্চ শাস্তি নির্ধারণের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তা কেউ কাউকে গ্রেফতার, আটক, অপহরণ বা স্বাধীনতা হরণের চেষ্টা করলে শাস্তি পাবে। যারা উচ্চপদে থেকে এ ধরনের কাজ সমর্থন করবে, তারা ও শাস্তির আওতায় আসবে।
আইন অনুযায়ী গ্রেফতার, আটক, অপহৃত ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ, তার অবস্থান বা অবস্থা গোপন রাখা এবং আইনগত সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে গুম সংক্রান্ত বিষয়ে তদন্ত ও মামলা করার ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে গুমকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। বিরোধী মত দমন করে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল। গুমের শিকার ব্যক্তি ও পরিবারের জন্য কোনো প্রতিকার ছিল না। হাসিনা বিদায়ের পরও একই কারণে গুমের প্রতিকার সম্ভব হয়নি। নতুন অধ্যাদেশ এই অচলায়তন ভেঙেছে। এটি কার্যকর হলে অতীতের যত গুমের ঘটনা ও সংশ্লিষ্ট অপরাধ হয়েছে, সব বিচারাধীন করা যাবে। পাশাপাশি নতুন করে গুম চালানোর সুযোগও বন্ধ হবে।

