২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জে পুলিশ প্রকাশ্যে তিন সাঁওতাল আদিবাসী কর্মীকে গুলি করে হত্যা করে। ঘটনাটি ঘটে সহস্রাধিক প্রতিবাদী সাঁওতাল ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর সামনে। একই সময়ে সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার এক ভয়াবহ তাণ্ডব চালানো হয়। এই ধ্বংসযজ্ঞে স্থানীয় জাতীয় সংসদ সদস্য ও ইউপি চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ অনুচররা অংশ নিয়েছিল। গুলিতে তিন আদিবাসী—শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডু নিহত হন। এ সময় আহত হন ১৫ থেকে ২০ জন।
আদিবাসী সাঁওতালদের একমাত্র অপরাধ ছিল তাদের কৃষিজমিতে আইনসম্মত স্বীকৃতির দাবি করা। যে জমিতে তারা আইনি স্বত্ব চাইছিলেন, তা মূলত সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর এবং কিছু বাঙালি পরিবারের পূর্বপুরুষদের মালিকানাধীন ছিল। ১৯৫৬ সালে ওই এলাকায় ‘রংপুর চিনিকল’ নামে একটি শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠার অজুহাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার তাদের উর্বর কৃষিজমি দখল করে নেয়। এটি করা হয় পূর্ব পাকিস্তান ভূমি রিকুইজিশন আইনের ক্ষমতাবলে।
১৯৬২ সালে রিকুইজিশন করা জমির মালিকদের সঙ্গে সরকার ও প্রশাসনের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির একটি শর্তে বলা হয়েছিল, যেহেতু এই ১৮৪২ একর জমি চিনিকলের কাঁচামাল হিসেবে আখ চাষের জন্য দখল করা হয়েছিল, যদি ভবিষ্যতে আখ চাষ বন্ধ হয়, তাহলে জমিটি পূর্বের মালিক বা তাদের উত্তরাধিকারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। রংপুর চিনিকল ২০০৪ সালে চিনি উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। দীর্ঘদিন ধরে এটি লোকসানি শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। চিনিকল কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা, অসততা এবং নানা ধরনের প্রতারণার দৃষ্টান্তও প্রকাশ পেত।
চুক্তিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল, ওই জমি শুধুমাত্র আখ চাষের জন্য ব্যবহার করা যাবে কিন্তু চিনিকল বন্ধ হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ সেই জমি বেআইনিভাবে স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু গোষ্ঠীকে লিজ দিতে শুরু করে। তারা সেখানে ধানের চাষ, সবজি আবাদ এবং বিভিন্ন ব্যবসায়িক কাজ করে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করে। বিশেষ কোনো গোষ্ঠীকে সম্পদশালী করার পথেও ধাবিত হয়। তবে এই লিজ প্রদান এবং জমির ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি ছিল; আইনের কোনো অনুমোদন ছিল না।
এই পরিস্থিতিতে সাঁওতাল আদিবাসী কৃষক এবং তাদের সহযাত্রী বাঙালি, যাদের পূর্বপুরুষ ওই জমির মালিক ছিলেন, ২০০৪ সাল থেকে আন্দোলন শুরু করেন। তাদের দাবি, ১৯৫৬ সালে রিকুইজিশন করা এই জমি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী চিনি উৎপাদন বন্ধ হওয়ার পর কৃষি আবাদের জন্য ফিরিয়ে দেওয়া হোক।
তারা জমির চারপাশে অস্থায়ী ঘর বানিয়ে বসবাস শুরু করেন এবং ধান চাষ শুরু করেন। যত্নসহকারে চাষ করার ফলে ১৮৪২ একর জমিতে ধান ও বিভিন্ন সবজির উৎপাদন হয়। কয়েকটি পুকুর থাকায় সেখানে মাছ চাষও চলে। জমি ধীরে ধীরে তিন-চার ফসলি ভূমিতে রূপান্তরিত হয়।
একই সঙ্গে তারা জেলা প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়ে জমিটি বৈধভাবে হস্তান্তরের আবেদন জানান। কয়েক দফা আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করা হয়। তবে প্রভাবশালী একটি মহল প্রশাসনের কাছে এই জমি সাঁওতালদের কাছে হস্তান্তর বন্ধ রাখতে নানা গুজব ছড়িয়ে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। অন্যদিকে স্থানীয় এমপি আবুল কালাম আজাদ প্রকাশ্যে সাঁওতালদের আন্দোলন সমর্থন করলেও, আড়ালে চক্রান্তকারীদের সঙ্গে মিলিয়ে তাদের উচ্ছেদের পরিকল্পনা করছেন বলে অভিযোগ ওঠে।
এরপর ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল উচ্ছেদ অভিযান চলে। সাঁওতালরা এই হামলা নীরবে মেনে নেননি। প্রথমে তারা নিজেদের সাংগঠনিক ঐক্য ও মনোবল দেখিয়ে তীর-ধনুক নিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। কিন্তু হামলাকারীরা সশস্ত্র ও সংঘবদ্ধ হওয়ায় সাঁওতালদের প্রতিরোধ তেমন কার্যকর হতে পারে না।

পুলিশ একপর্যায়ে নির্বিচারে গুলি বর্ষণ শুরু করে। এর ফলে তিনজন সাঁওতাল আদিবাসী নেতা নিহত হন। পাশাপাশি সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। নারী-শিশুসহ কয়েকশ পরিবার কয়েক দিন খোলা আকাশের নিচে দিনযাপন করতে বাধ্য হয়। পরে তারা খড়, বাঁশ ও অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে অস্থায়ী ঘর বানিয়ে বসবাস শুরু করে। এভাবেই তারা মানবেতর জীবনযাপনের এক করুণ ইতিহাস রচনা করেছেন। তৎকালীন সংবাদমাধ্যমে এই ঘটনার সচিত্র প্রতিবেদন আংশিকভাবে প্রকাশিত হলেও, পুরো বিবরণ সরকারি চাপে প্রকাশ হয়নি। তবে কাতারভিত্তিক আলজাজিরার সচিত্র প্রতিবেদনে পুরো সত্য প্রকাশ পেয়েছিল।
এই অমানবিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় পুলিশের নির্মম আচরণ ও অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধের প্রতিবাদে দেশের নাগরিক সমাজ এবং স্থানীয় সাধারণ মানুষ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। ঘটনার পরপরই মানবাধিকারকর্মী, নাগরিক সমাজের নেতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী ঢাকা, রাজশাহী, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ওই এলাকায় গিয়ে ঘটনা জানার চেষ্টা করেন এবং পরে দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরেন। নিহত ও আহত সাঁওতাল পরিবারের পাশে তারা দাঁড়ান।
দেশের তিনটি মানবাধিকার ও ভূমি অধিকার সংগঠন—আইন ও সালিশ কেন্দ্র, এএলআরডি এবং ব্রতী—রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার দায় চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট আবেদন দাখিল করে (রিট পিটিশন নম্বর: ১৪৪০২/২০১৬)।
রিট আবেদনের পর তৎকালীন হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চের দুই বিচারপতি কয়েকটি নির্দেশনা দেন। এর মধ্যে ছিল—সাঁওতালদের রক্ষার জন্য সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নিক এবং তাদের উৎপাদিত ফসল সাঁওতালদের ঘরে পৌঁছানো নিশ্চিত করুক। পাশাপাশি রুল জারি করা হয়, কেন সরকারের নিষ্ক্রিয়তা অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা আদালতে প্রমাণ করতে হবে। শুনানির বিভিন্ন পর্যায়ে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে আদালতে ডাকা হয় এবং তারা তাদের ব্যর্থতার জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। পরে হাইকোর্ট পুলিশ সুপারসহ ওই দিনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ৮২ জন পুলিশ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে এলাকা থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। এছাড়া, সাঁওতালদের বাড়িতে আগুন লাগানোর ঘটনায় জড়িত দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।
এ ঘটনার পর থেকে পৈতৃক সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার দাবিতে সাঁওতাল ও স্থানীয় বাঙালিরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তৎকালীন সরকার যেমন তাদের যৌক্তিক দাবি উপেক্ষা করে নির্যাতন চালিয়েছিল, বর্তমান প্রশাসনও তাদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। কখনও তারা ঘোষণা করে, এখানে ইপিজেড করা হবে; কখনও অন্য প্রকল্প হবে—এই যুক্তিতে উচ্ছেদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। গোবিন্দগঞ্জ থানায় দায়ের করা হত্যা মামলার চার্জশিট এখনও হয়নি, নয় বছর পেরিয়েও। নিহত ও আহতদের স্বজনরা এখন অন্তর্বর্তী সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। তারা বিশ্বাস করেন, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের যৌক্তিক দাবি মানবেন এবং পৈতৃক সম্পত্তি ফেরত দেবেন। এতে হয়তো শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডুর বিদেহী আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে। সূত্র: সমকাল

