বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে গরিবের ল্যাট্রিন, গ্রামীণ পানি সরবরাহ ও স্বাস্থ্যবিধি উন্নয়নের নামে চলছে বড় ধরনের দুর্নীতি। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নেওয়া এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ডিসেম্বরে কিন্তু এখনো কাজের অগ্রগতি মাত্র ৪৭ শতাংশ। সম্পন্ন কাজের মধ্যেও অনিয়ম ও নিম্নমানের নির্মাণের অভিযোগ অসংখ্য।
সরকারের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এবং যুগান্তরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে—বেশিরভাগ কাজেই দরপত্রের নির্ধারিত স্পেসিফিকেশন মানা হয়নি। প্রকল্পের আওতায় নির্মিত প্রায় ৮০ শতাংশ পাবলিক টয়লেট ইতোমধ্যেই ব্যবহারহীন বা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, কিছু জেলায় পানির ছোট স্কিমের কাজ বন্ধ হয়ে আছে। পাবলিক ও কমিউনিটি ক্লিনিকের টয়লেট নির্মাণকাজও শেষ হয়নি, একাধিকবার সময় বাড়ানো সত্ত্বেও। পরিদর্শিত ৪৭টি স্কিমের মধ্যে মাত্র ৪টিতে নির্ধারিত স্পেসিফিকেশন অনুসারে ৩ ফুট মাটির নিচে পাইপ বসানো হয়েছে। বাকি ৪৩টি স্কিমে কাজ হয়েছে নিয়মবহির্ভূতভাবে।
ত্রুটিপূর্ণ নির্মাণের কারণে অনেক ল্যান্ডিং স্টেশন ভেঙে গেছে, কলাম বাঁকা হয়েছে। র্যাম্প নির্মাণেও অনিয়ম পাওয়া গেছে—কোথাও গাইড ওয়াল করা হয়নি, ফলে টয়লেটগুলো বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীবান্ধব হয়নি।
পরিদর্শিত ৪৭টি পাবলিক টয়লেটের মধ্যে ৩৮টি বর্তমানে ব্যবহার হয় না। কিছু টয়লেট বছরে মাত্র দুই-তিন দিন খোলা থাকে, বাকি সময় বন্ধ থাকে। ৩৬টি হাত ধোয়ার স্টেশনের মধ্যে মাত্র ১১টি ভালো অবস্থায় থাকলেও সেগুলোও ব্যবহার করা হয় না। বাকি ৭০ শতাংশ স্টেশন ভাঙাচোরা ও পানির মান খারাপ হওয়ায় পরিত্যক্ত।
একইভাবে কমিউনিটি ক্লিনিকের ১৯টি টয়লেটের মধ্যে ১৭টি (৮৯%) ব্যবহার অনুপযোগী। কারণ হিসেবে দেখা গেছে—পরিচ্ছন্নতাকর্মীর অভাব, পরিষ্কারের সরঞ্জাম না থাকা, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও চুরির আশঙ্কা।
ল্যাট্রিন নির্মাণেও ছিল গুরুতর অনিয়ম। কোনোটি নির্ধারিত বালির স্তর ও ভিত্তি ছাড়াই স্থাপন করা হয়েছে। এতে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। পানির বড় স্কিমগুলো করা হয়েছে পুকুর ও ডোবা ভরাট করে, অথচ পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি।
অভিযোগ উঠেছে, প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মো. তবিবুর রহমান তালুকদার ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। তিনি এককভাবে প্রকল্পের বিল ও চেক অনুমোদন করেন। এতে অন্য কোনো প্রকৌশলীর কার্যকর ভূমিকা থাকে না। ফলে পছন্দের ঠিকাদারদের দিয়ে ব্যাপক লুটপাটের সুযোগ পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
তবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ—অবৈধ অর্থে তিনি সিরাজগঞ্জে ছয়তলা বাড়ি, ধানমন্ডিতে পাঁচ হাজার বর্গফুটের বাণিজ্যিক ফ্লোর, দুটি ফ্ল্যাট এবং ব্যাংককে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। রয়েছে একাধিক গাড়িও। ব্যক্তিগত জীবনে বিয়েবহুল ও নানা কেলেঙ্কারির কথাও শোনা যায়। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করলেও তিনি প্রভাব খাটিয়ে তদন্ত প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করছেন বলে অভিযোগ আছে।
দুর্নীতির অভিযোগে জর্জরিত এই কর্মকর্তা তবিবুর রহমানকেই আবারও ১৮৮৯ কোটি টাকার নতুন স্যানিটেশন প্রকল্পের পরিচালক করা হয়েছে—এটিও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। এ নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে তোলপাড় শুরু হয়েছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকসুদ জাহেদী বলেন, “আইএমইডির প্রতিবেদনটি এখনো আমার হাতে আসেনি। দেখে ব্যবস্থা নেব। যদি পিডির সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
যোগাযোগ করা হলে তবিবুর রহমান তালুকদার বলেন, “আমি ফোনে কিছু বলব না। দেখা হলে কথা বলা যাবে।” পরবর্তী সময়ে সাক্ষাতের অনুরোধ জানালে তিনি জানান, “সময় হলে জানাব।”

