ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের একই ঠিকানায় নিবন্ধিত তিনটি কোম্পানি থেকে জাহাজ কিনেছে ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান মো. শওকত আলী চৌধুরীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এস. এন. করপোরেশন। তবে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) অনুসন্ধানে এই তিন প্রতিষ্ঠানের কোনো কার্যকর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে জানা গেছে, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের চট্টগ্রাম শাখা ২০১৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এস. এন. করপোরেশনের পক্ষে তিনটি ঋণপত্র (এলসি) খুলেছিল। এসব এলসির সুবিধাভোগী ছিল ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে নিবন্ধিত তিন প্রতিষ্ঠান—রেড রুবি গ্রুপ লিমিটেড, ট্যালেন্ট মাইল লিমিটেড ও কলাম্বিয়া সিস লিমিটেড।
বিএফআইইউ জানিয়েছে, এই তিন কোম্পানির নিবন্ধন সংক্রান্ত তথ্য হাতে পাওয়ার পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সম্প্রতি ইস্টার্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান শওকত আলী চৌধুরী ও তার পরিবারের বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার লেনদেন নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে।
বিএফআইইউ’র প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের ওই তিন কোম্পানির সঙ্গে এস. এন. করপোরেশনের এলসি লেনদেনের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে—২০১৫ সালে এলসি নং ২৪৯৪১৫০২০০৩৯, মূল্য ৭৪ দশমিক ৯৬ লাখ ডলার; ২০২০ সালে এলসি নং ২৪৯৪২০০১০০২৫, মূল্য ৪ দশমিক ৬৪ লাখ ডলার; এবং ২০২৩ সালে এলসি নং ২৪৯৪২৩০১০০১৩, মূল্য ২১ দশমিক ৪১ লাখ ডলার। তিনটি এলসিতেই আমদানিকারক ছিল এস. এন. করপোরেশন, আর বেনিফিসিয়ারি কোম্পানিগুলো ছিল ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের একই ঠিকানায় নিবন্ধিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, এমন উচ্চ ঝুঁকির দেশভিত্তিক লেনদেনে ব্যাংকগুলোকে ‘এনহ্যান্সড ডুয়ো ডিলিজেন্স’ (Enhanced Due Diligence-EDD) প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। কিন্তু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক এই প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই এলসিগুলো স্থাপন করেছে। এতে গাইডলাইনস ফর ফরেন এক্সচেঞ্জ ট্রানজেকশনস-২০১৮ লঙ্ঘিত হয়েছে।
বিএফআইইউ’র তদন্তে আরও উঠে এসেছে, ট্যালেন্ট মাইল লিমিটেডের ইমেইল ঠিকানা রেড রুবি গ্রুপ লিমিটেডের সঙ্গে মিলে গেছে। এতে দুটি কোম্পানির মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থের যোগসাজশ থাকার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এই সব তথ্যের আলোকে ধারণা করা হচ্ছে, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের সন্দেহভাজন শেল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে এমন লেনদেন বৈদেশিক বাণিজ্যে স্বচ্ছতা এবং অর্থ পাচারের ঝুঁকি নিয়ে নতুন প্রশ্ন তুলেছে।
সাধারণত পুরোনো জাহাজ বা স্ক্র্যাপ ভেসেল আমদানি করা হয় শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে ভাঙার জন্য। এসব জাহাজ ভেঙে পাওয়া লোহা, স্টিল, তামা, অ্যালুমিনিয়াম ও যন্ত্রাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের প্রধান শিপ ব্রেকিং কেন্দ্র চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূলে। এখানে শতাধিক ইয়ার্ডে বছরে শতাধিক জাহাজ ভাঙা হয়। এ খাত থেকে দেশের মোট রড ও লোহা চাহিদার প্রায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ সরবরাহ হয়।
চেয়ারম্যান ও পরিবারের ৮ হাজার কোটি টাকার লেনদেন:
ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান মো. শওকত আলী চৌধুরী, তাঁর স্ত্রী তাসমিয়া আম্বারীন, মেয়ে যারা নামরীন, ছেলে মো. জারান আলী চৌধুরী এবং তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ২৮টি ব্যাংকে মোট ১৮৭টি হিসাব শনাক্ত করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
তথ্য অনুযায়ী, শওকত আলীর নামে ১৪টি, তাসমিয়া আম্বারীনের নামে ১৫টি, যারা নামরীনের নামে ৯টি, জারান আলীর নামে ৩টি এবং তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে ১৪৬টি হিসাব রয়েছে। চলতি বছরের ১৫ জুলাই পর্যন্ত এসব হিসাবে মোট ৮৪০৭ দশমিক ৯ কোটি টাকা জমা হয়েছে এবং ৮২৪৭ দশমিক ৫ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। বর্তমানে এসব হিসাবে সম্মিলিত স্থিতি রয়েছে প্রায় ১৭৩ দশমিক ৫৩ কোটি টাকা।
বিএফআইইউ জানিয়েছে, এসব হিসাবের কেওয়াইসি, লেনদেন বিবরণী ও সহায়ক দলিলাদি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ওপেন সোর্স, বিএসইসি, ভূমি মন্ত্রণালয়, জাতীয় সঞ্চয়পত্র ও সরকারি বন্ড সংক্রান্ত তথ্যও যাচাই করা হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিদেশি সম্পদ ও বিনিয়োগের তথ্য সংগ্রহের কাজ এখনো চলছে।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে বিএফআইইউ দেখেছে, শওকত আলী চৌধুরীর মালিকানাধীন এস. এন. করপোরেশন ২০১২ সাল থেকে পুরোনো জাহাজ আমদানি সংক্রান্ত ১৪১টি ঋণপত্র (এলসি) খুলেছে। এর মধ্যে ১১টি এলসি বিশ্লেষণে জাহাজগুলোর চূড়ান্ত গন্তব্য চট্টগ্রাম বন্দর হওয়ার নিশ্চিত তথ্য মেলেনি। বরং, জাহাজ বিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রকাশনা লোয়েড’স লিস্ট এর তথ্যে এক জাহাজের দুটি ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের একই ঠিকানায় নিবন্ধিত তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে পুরোনো জাহাজ কেনার তথ্যও অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, যা সন্দেহজনক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এর পরপরই শওকত আলী চৌধুরী, তাঁর পরিবার ও তাঁদের অন্যান্য ব্যবসার হিসাবও তদন্তের আওতায় আনা হয়।
বিএফআইইউ’র তদন্তে বিভিন্ন ব্যাংকে অনুসন্ধানে যা উঠে এলো:
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তদন্তে ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান মো. শওকত আলী চৌধুরী, তাঁর পরিবার ও তাঁদের প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবগুলোতে একাধিক সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য উঠে এসেছে।
বিএফআইইউ’র প্রাথমিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শওকত আলীর নামে ঢাকা ব্যাংক পিএলসির জুবিলি রোড শাখায় ২০০৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত একটি প্লাটিনাম হিসাব ছিল। এই হিসাবে মোট ৩৯৮ কোটি টাকা জমা ও সমপরিমাণ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। যদিও এটি ব্যক্তিগত হিসাব, তবে ব্যবহার করা হয়েছে তাঁর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এস. এন. করপোরেশনের লেনদেনে—যা কর ফাঁকির আশঙ্কা তৈরি করেছে।
তদন্তে আরও জানা যায়, শওকত আলী চেয়ারম্যান থাকা ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসির আগ্রাবাদ শাখায় তাঁর একটি ব্যক্তিগত প্রিমিয়াম সেভিংস হিসাব রয়েছে। এই অ্যাকাউন্ট থেকে ব্যাংকের কোম্পানি সেক্রেটারি আব্দুল্লাহ আল মামুন ১২৫ বার নগদ টাকা উত্তোলন করেছেন। শওকত আলী ব্যাংকের পরিচালক ও দ্বিতীয় মেয়াদের চেয়ারম্যান হওয়ায়, এই লেনদেনগুলোতে ক্ষমতার অপব্যবহারের সন্দেহ করা হচ্ছে।
একই শাখায় শওকতের মেয়ে যারা নামরীনের একটি সঞ্চয়ী হিসাবে ২০১৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৩১ কোটি টাকা জমা পড়েছে। বিএফআইইউ বলছে, তার ঘোষিত আয়ের সঙ্গে এই অর্থের পরিমাণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ। হিসাবের উৎস হিসেবে শেয়ার লেনদেন ও এস. এন. করপোরেশনের নাম উল্লেখ থাকায় এটি কর ফাঁকির ইঙ্গিত দেয়। এছাড়া যারা নামরীনের প্রিমিয়াম সেভিংস হিসাব থেকেও ৯৮ বার নগদ উত্তোলন করেছেন একই কর্মকর্তা, কোম্পানি সেক্রেটারি আব্দুল্লাহ আল মামুন—যা ব্যক্তিগত হিসাব থেকে ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রমাণ হিসেবে ধরা হচ্ছে।
তদন্তে আরও দেখা যায়, মিডল্যান্ড ব্যাংক পিএলসির আগ্রাবাদ শাখায় শওকতের ছেলে জারান আলী চৌধুরীর ‘সুপার সেভার’ হিসাবে এস. এন. করপোরেশন থেকে অর্থ স্থানান্তর ও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ হয়েছে। যদিও তাঁর আয়ের উৎস হিসেবে দেখানো হয়েছে মায়ের ব্যবসা, যা বিএফআইইউ সন্দেহজনক বলে উল্লেখ করেছে।
মিউচুয়্যাল ট্রাস্ট ব্যাংক পিএলসির জুবিলি রোড শাখায় এস. এন. করপোরেশনের সিসি (হাইপো) হিসাব থেকেও নামরীন এন্টারপ্রাইজসহ শিপ ব্রেকিং খাতের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে অর্থ স্থানান্তরের প্রমাণ পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে নিড ড্রেসেস প্রাইভেট লিমিটেডের হিসাবে ৫০ দশমিক ৪০ লাখ টাকা জমা হওয়াও সন্দেহকে আরও গভীর করেছে।
সিটি ব্যাংক পিএলসির আগ্রাবাদ শাখায় শওকত আলীর ব্যক্তিগত হিসাবের মাধ্যমে ৩ কোটি টাকা জমা দিয়ে মিডওয়ে সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ এবং ১০৬ কোটি টাকা জমা করে তা পরে এস. এন. করপোরেশনে পাঠানো হয়। এই ধরনের লেনদেন কর ফাঁকির উদ্দেশ্যে ব্যবসায়িক লেনদেন আড়াল করার ইঙ্গিত দেয় বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এছাড়া দি প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেডের আগ্রাবাদ শাখা প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন ছাড়াই এস. এন. করপোরেশনকে ২৬ দশমিক ৯ কোটি টাকার এলটিআর সুবিধা দিয়েছে। শাখা কার্যালয় আগেভাগে এই ঋণ অনুমোদন দেয় এবং পরে পোস্ট-ফ্যাক্টো অনুমোদন নেয়—যা ব্যাংকিং নীতি ও নিয়মের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে ইস্টার্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. শওকত আলী চৌধুরীকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। বিএফআইইউ’র প্রতিবেদনে উল্লেখিত অনিয়ম নিয়ে লিখিতভাবে মতামত চাওয়া হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।

