ফেনীতে ফ্যাসিবাদী আমলের বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। জেলার পতিত গডফাদার নিজাম হাজারীর আশীর্বাদে তৎকালীন সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, শিক্ষক ও কর্মচারীদের একটি অসাধু সিন্ডিকেট এই লুটপাটে সক্রিয় ছিল। নাম-বেনামে বিল ও ভাউচার ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ২৪ শে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বছর না যেতেই এই চাঞ্চল্যকর তথ্য-প্রমাণ সামনে এসেছে।
ফেনী সরকারি কলেজের কম্পাউন্ডে এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে সরকারি ও স্থানীয় সরকার থেকে সংগৃহীত টাকা ব্যবহার করা হয়। এতে কলেজের জমি অপচয় হওয়াসহ বিপুল অর্থ লুটপাট হয়েছে। প্রশাসন ও রাজনীতিক নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত বাস্তবায়ন কমিটিতে কয়েকজন সাংবাদিক থাকায় ব্যয়ভার নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে সাহস পাননি।
বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, ২০২২ সালের নভেম্বরে বধ্যভূমির ডোবায় বালুভরাট করে ৬১,৫২৫ বর্গফুট জায়গায় ১৯,৬১৭ বর্গফুট আয়তনে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। এতে রয়েছে ৪০ ফুট উচ্চতার তিনটি দেয়াল, আট ফুট ছয় ইঞ্চি উচ্চতার প্লাজা লেভেল, ছয়টি স্ট্রিং যুক্ত ঝুলন্ত পোস্ট ও পানির ধারা। এছাড়া পাঁচ ধাপ বিশিষ্ট বসার স্থান ও একটি উন্মুক্ত মঞ্চও তৈরি করা হয়। বধ্যভূমির ইতিহাস খচিত চারটি ছোট স্মারক স্তম্ভ, তিনটি বসার স্থান, জাতীয় পতাকা, পানির ড্রেনেজ, সবুজায়ন ও আলোকায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে সীমানা প্রাচীরের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হয়নি।
সূত্র জানায়, জেলা পরিষদ থেকে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে এক কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে ৬৩ লাখ, ফেনী সরকারি কলেজের উন্নয়ন তহবিল থেকে ৫০ লাখ, ফেনী পৌরসভা থেকে ২৩ লাখ এবং সদর উপজেলা পরিষদ থেকে ২০ লাখ টাকা দেওয়া হয়। এছাড়া কমিটির সদস্যরা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকেও অর্থ সংগ্রহ করেছেন।
কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রফেসর বিমল কান্তি পালকে আহ্বায়ক এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. মাসুদুর রহমানকে সদস্য সচিব করা হয়। কমিটিতে ছিলেন সদর উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসেন পাটোয়ারী, আওয়ামী লীগ দলীয় জনপ্রতিনিধি ও তৎকালীন পৌর মেয়র নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজী, সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান শুসেন চন্দ্র শীল, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবদুল মোতালেব, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের, সাংবাদিক বখতেয়ার ইসলাম মুন্না ও আরিফুল আমিন রিজভী এবং ফেনী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি তোফায়েল আহমেদ তপু।
ফেনী পৌর প্রশাসক ও জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক গোলাম মো. বাতেন নিশ্চিত করেছেন, পৌরসভার তহবিল থেকে বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভের জন্য ২০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। সদর উপজেলা প্রকৌশলী দীপ্ত দাস গুপ্ত জানান, এই আদলে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে প্রায় এক কোটি টাকা খরচ হতে পারে। তবে সরেজমিনে পরিদর্শন করে প্রকৃত ব্যয় নির্ধারণ করা যাবে।
ফেনী সরকারি কলেজে বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে প্রায় ৫০ লাখ টাকা কলেজের নিজস্ব ফান্ড ব্যবহার করা হয়েছে। কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মদ এনামুল হক খোন্দকার বলেন, “কীভাবে এই টাকা ব্যবহার করা হয়েছে, তা পূর্বের অধ্যক্ষরাই ভালো বলতে পারবেন।”
তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পুরোনো বধ্যভূমি স্থাপনাকে সংরক্ষণ না করে নতুন করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। এতে শুধু কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়নি, শিক্ষার্থীর সুবিধাও ব্যাহত হয়েছে। অধ্যক্ষের মতে, যদি ওই স্থানে ভবন নির্মাণ করা যেত, ২২ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য শ্রেণিকক্ষ, বিজ্ঞানাগার ও ল্যাবের সংকট দূর করা যেত।
বিশ্লেষণ অনুযায়ী, কলেজের তহবিল থেকে এই অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে এমন সিদ্ধান্ত শিক্ষা ও ইতিহাস সংরক্ষণের সমন্বয়হীনতার প্রতিফলন। প্রশাসন ও কমিটির অগোছালো পরিকল্পনা শিক্ষার্থীর মৌলিক সুবিধা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

