বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ৪৫ বছর আগের পুরনো মডেলের চারটি ব্ল্যাক হক ‘অ্যাটাক’ হেলিকপ্টার কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রতিটির দাম ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। চারটি হেলিকপ্টারের মোট খরচ প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার বা ১২০০ কোটি টাকার বেশি।
প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ অস্বচ্ছ। এটি শেখ হাসিনার তৎকালীন নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিকের কোম্পানিকে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।
নির্ভরযোগ্য প্রতিরক্ষা সূত্র জানায়, পুরনো মডেলের হেলিকপ্টার কেনার প্রক্রিয়া দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। এর জন্য তারিক আহমেদ সিদ্দিক ও এহতেশাম হুদার কোম্পানি আইআরআইএস টেক কে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তাদের মূল সরবরাহকারী মার্কিন কোম্পানি এক্সপি সার্ভিসেস। এছাড়া সহায়ক হিসেবে আরএসজি কোম্পানিকেও যুক্ত করা হয়েছে। তাদের স্থানীয় এজেন্ট জেমিমেন ইন্টারন্যাশনাল । জানা গেছে, টেন্ডার ডকুমেন্ট তৈরিসহ কেনাকাটার যাবতীয় কার্যক্রমে আইআরআইএস টেক সরাসরি জড়িত। কাজটি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিরক্ষা ক্রয় মহাপরিদপ্তর সেনাবাহিনীর কাছে নতুন মডেলের হেলিকপ্টার কেনার সুপারিশ করেছিল। বিষয়টি নিয়ে বক্তব্যের জন্য ডিজিডিপি অফিসে যোগাযোগ করা হলে তারা আইএসপিআর-এর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেয়। তবে আইএসপিআরকে ফোন করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি। খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠানো হলেও গতকাল রাত পর্যন্ত কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। আইআরআইএস টেক কোম্পানির পার্টনার এহতেশাম হুদাকে ফোন করা হলে তিনি জানান, “এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না, সেনাবাহিনীর সঙ্গে কথা বলুন।”
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তারিক সিদ্দিকের অন্যতম ব্যবসায়িক পার্টনার এহতেশাম হুদা ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের ক্যুর সহযোগী কর্নেল নাজমুল হুদার ছেলে। এহতেশাম হুদার বোন নাহিদ ইজহার খান ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শে ‘মায়ের কান্না’ নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই সংগঠন গুমের প্রতিবাদকারী সানজিদা ইসলাম তুলির ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনটির গুমবিরোধী কর্মসূচির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের চরিত্র হনন করে বিবৃতি দিয়েছে।
জানা গেছে, শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকা বিগত সরকারের সময় তারিক সিদ্দিক ও এহতেশাম হুদা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য ‘ব্ল্যাক হক’ নামের ‘অ্যাটাক’ হেলিকপ্টার আনার প্রাথমিক পাঁয়তারা শুরু করেন। এ উদ্দেশ্যে তারা নিজেদের কোম্পানি আইআরআইএস টেকের মাধ্যমে টেন্ডার ডকুমেন্ট তৈরি করে।
পরবর্তীতে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ওই মহল কিছুদিন চুপ থেকে পুনরায় হেলিকপ্টার প্রক্রিয়া পাওয়ার নীলনকশা তৈরি করে। প্রতিরক্ষা ক্রয় মহাপরিদপ্তর থেকে চারটি হেলিকপ্টার কেনার দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রের শিডিউল ছিল ১৯ জুলাই থেকে ১৪ অক্টোবর ২০২৫ পর্যন্ত এবং ১৫ অক্টোবর দরপত্র খোলা হয়। দরপত্র নম্বর ২২১.৫৬৭.২৫। হেলিকপ্টারের বিবরণ অনুযায়ী, এটি মিডিয়াম হেলিকপ্টার (মাল্টি ইঞ্জিন, রিফারবিস্ট), মডেল ব্ল্যাক হক, ইউএইচ-৬০এল সিরিজ, ইউএসএ চারটি।
ইতোমধ্যে সেনাবাহিনীর মাস্টার জেনারেল অব অর্ডন্যান্স মেজর জেনারেল আবু বকর সিদ্দিক খানের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল হেলিকপ্টার কেনার কাজের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে ৭ দিনের সফরে গেছেন। অন্য সদস্যরা হলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম আরিফ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান এবং কর্নেল খসরু সাব্বির আলী।
কোম্পানির মূল মালিক তারিক সিদ্দিক হলেও কৌশলের অংশ হিসেবে তার নাম কোথাও প্রকাশ করা হয়নি। আইআরআইএস টেকের কাগজপত্রের মালিক হিসেবে দেখানো হয়েছে এহতেশাম হুদাকে। তার পিতা কর্নেল নাজমুল হুদা (মৃত), মাতা নিলুফার হুদা। কর্নেল নাজমুল হুদা ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নির্দেশে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে সেনানিবাসে বন্দি করেছিলেন। পরে তিনি এবং তার সহকর্মীরা শেরেবাংলা নগরের একটি সেনা ইউনিটে আশ্রয় নিলে সৈনিকদের হাতে নিহত হন।
এহতেশামের বোন নাহিদ ইজহার খানকে শেখ হাসিনা সংরক্ষিত আসনের এমপি এবং সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। ২০২৩ সালে নাহিদ ইজহার খান মরহুম জিয়াউর রহমানের নামে শের-ই-বাংলানগর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। তখনকার ওসি ছিলেন উৎপল কুমার বড়ুয়া। মামলার পর নাহিদকে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচন করা হয়।
তদন্তে জানা গেছে, আওয়ামী আমলে তারিক সিদ্দিক এহতেশামকে সামরিক বাহিনীতে একাধিক বিমান সরবরাহ, এমআরও এবং যন্ত্রাংশসহ হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কেনাকাটার নামে টেন্ডারের দাম বাড়িয়ে একচেটিয়া নামসর্বস্ব টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ দেওয়া হয়েছে। এহতেশাম হুদা এর আগে জয়নুল হক শিকদারের কোম্পানি শিকদার গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। মরহুম জয়নুল হক শিকদারের ছেলে রন হক ও রিক হক শিকদারের সঙ্গে মিলে এহতেশাম বিভিন্ন অভিযোগে যুক্ত ছিলেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে রন হক ও রিক হক শিকদার পলাতক রয়েছেন।
নির্ভরযোগ্য প্রতিরক্ষা সূত্র জানায়, দরপত্র বিজ্ঞপ্তির পণ্যের বিবরণ ও পরিমাণ কলামে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে ৪টি মিডিয়াম হেলিকপ্টার মাল্টি ইঞ্জিন রিফারবিশড, মডেল ব্ল্যাক হক, ইউএইচ সিক্স জিরো এল সিরিজ, ইউএসএ। একজন সামরিক বিশেষজ্ঞ দরপত্র বিজ্ঞপ্তি বিশ্লেষণ করে বলেন, “এখানে বিবেচনার বিষয় হলো—[বক্তব্য সম্পূর্ণ হলে এখানে সংযুক্ত করা হবে]।”
ক) মিডিয়াম হেলিকপ্টার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কোম্পানি তৈরি করে থাকে। তবু দরপত্রে ‘মডেল ব্ল্যাক হক, ইউএইচ-৬০এল সিরিজ, ইউএসএ’ সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি শুধু ক্রয় নীতিমালার ব্যত্যয় নয়, বরং কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের নীলনকশা বাস্তবায়নের বহিঃপ্রকাশ বলেও মনে হচ্ছে।
খ) সরকারি ক্রয় নীতিমালায় ‘রিফারবিশড’ কোনো আইটেম দরপত্রের মাধ্যমে কেনার সুযোগ নেই। যদি ‘রিফারবিশড আইটেম’ ক্রয় অনিবার্য হয়, তবে একমাত্র সরকার টু সরকার অর্থাৎ ‘জি টু জি’ ব্যবস্থার মাধ্যমে তা কেনা সম্ভব। সেখানে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী থাকতে পারবে না। এই হেলিকপ্টার কেনার প্রক্রিয়ায় দেখা যাচ্ছে, পুরনো হেলিকপ্টার মধ্যস্বত্বভোগীর মাধ্যমে কেনার চেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়া ব্ল্যাক হক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানদের দরপত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়নি।
গ) কর্মকর্তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে এমআরও (Maintenance and Repair Organization) পরিদর্শন করবেন। কোনো হেলিকপ্টার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে নয়। অর্থাৎ এখানে মূলত বিমান মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান থেকে পুরনো ও মেরামতকৃত হেলিকপ্টার কেনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ঘ) ‘ব্ল্যাক হক’ একটি সামরিক হেলিকপ্টার। কেন এবং কোন বিবেচনায় এ ধরনের পুরনো ও মেরামতকৃত যুদ্ধবিমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সংযোজনের চেষ্টা করা হচ্ছে, তা গভীর পর্যালোচনার দাবি রাখে। এছাড়া সম্প্রতি সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোনো সাপ্লাইয়ারের খরচে বিদেশ ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এমতাবস্থায় হেলিকপ্টার সাপ্লাইয়ারের খরচে কতজন কর্মকর্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশে কোনো হেলিকপ্টার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান নেই। তাই দরপত্রে ‘দেশীয়/বৈদেশিক মুদ্রায়’ এবং ‘প্রকৃত ব্যবসায়ী/প্রস্তুতকারকদের’ কাছ থেকে দরপত্র আহ্বান করা একে অপরের সঙ্গে পরস্পরবিরোধী। এছাড়া কোনো প্রস্তুতকারকের পক্ষে ‘রিফারবিশড’ হেলিকপ্টার সরবরাহ করা সম্ভব নয়। নির্ভরযোগ্য সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরনের জটিল ও অসঙ্গত দরপত্রের লক্ষ্য হতে পারে কোনো ব্যক্তিবিশেষ বা গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা। প্রতারণার মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে হেলিকপ্টার সংযোজন করা হচ্ছে। ‘অ্যাটাক’ হেলিকপ্টারের নামে বিমান মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান থেকে এই উদ্যোগ নেওয়ায় সামরিক মহলে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
হেলিকপ্টারের মতো স্পেশালাইজড সরঞ্জাম সংগ্রহের ক্ষেত্রে ক্যাপিটাল ইকুইপমেন্ট স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন বাধ্যতামূলক। এছাড়া প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ‘সার্টিফিকেট অফ অরিজিন’ সংগ্রহ বাধ্যতামূলক। এটি এমআরও-এর পক্ষে সরবরাহ সম্ভব নয়। এই সার্টিফিকেট দায়দায়িত্বের প্রমাণ বহন করে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সামরিক বিশেষজ্ঞ বলেন, সেনাবাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য হেলিকপ্টার প্রয়োজন। তবে কেন ১৯৮০ সালের পুরোনো মডেল কেনা হচ্ছে, তা বোধগম্য নয়। নতুন মডেল অন্তত ২০০০ সালের পরের হওয়া উচিত।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এই স্পর্শকাতর বিষয়টি ৫ আগস্টের শহীদদের রক্তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইতোমধ্যে তারিক সিদ্দিক ও এহতেশামের বোন নাহিদ ইজহার খান ৫ আগস্টের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। অভিযোগ রয়েছে, এহতেশাম হুদা তারিক সিদ্দিকের সঙ্গে অর্থপাচার, গুম, খুনসহ বিভিন্ন সামরিক কর্মকর্তাকে নিপীড়নের সঙ্গে যুক্ত। তারা যে কোনো সময় পালিয়ে যেতে পারেন। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে অযোগ্য ঘোষণার পাশাপাশি সাবেক সরকারের দোসর হিসেবে এহতেশামকে গ্রেপ্তার করা উচিত। তাকে রিমান্ডে নিলে তারিক সিদ্দিকসহ সব দেশদ্রোহীর কর্মকাণ্ড জনগণ জানতে পারবে।

