শুধু ব্যাংক লুট করেই ক্ষান্ত হননি চৌধুরী নাফিজ সরাফত। রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে তার অনিয়ম ও দুর্নীতির ছায়া বিস্তৃত ছিল। সুযোগ পেলেই প্রতারণা করে বিপুল বিত্ত অর্জন করেছেন তিনি। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত কাণ্ড হলো পূর্বাচলের জমি প্রতারণা করে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশকে দেওয়া।
নাফিজ সরাফত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। ট্রাস্টি বোর্ডের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এ আরাফাত। পরবর্তীতে তিনি আওয়ামী লীগের শেষ মন্ত্রিসভার তথ্য প্রতিমন্ত্রী হন। ২০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর রাজউক পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১৭১ দশমিক ১৬ কাঠার একটি প্লট এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বরাদ্দ দেয়। এতে সরকারের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৭৭ কোটি টাকা। সূত্রে জানা যায়, মূল নকশায় ওই প্লট ছিল ‘সেকেন্ডারি স্কুল’। কিন্তু ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর নাফিজ সরাফত ‘কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে পরিবর্তনের জন্য আবেদন করেন। পর্ষদ সভায় উপস্থাপনার পর ২৬ ডিসেম্বর অনুমোদন দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়ায় রাজউকের নিয়মনীতি অনুসরণ করা হয়নি।
ক্ষমতার অপব্যবহার করে নাফিজ সরাফত ও তার পরিবার একাধিক ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন। গুলশানের ১০৩ নম্বর সড়কের একটি প্লটের মালিক তার স্ত্রী আঞ্জুমান আরা সাহিদ চৌধুরী। ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই তিনি এটিকে বাণিজ্যিক প্লট করার আবেদন করলে তৎকালীন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের হস্তক্ষেপে রাজউক অনুমোদন দেয়। অথচ আগেই জানানো হয়েছিল, এই প্লট ‘বাণিজ্যিক ব্যবহারের আওতায় নয়’। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে রাজউক অনুমতি দেয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে নাফিজ সরাফত যা চেয়েছিলেন তাই পেয়েছেন। ক্ষমতা ও প্রভাব ব্যবহার করে তিনি ঢাকার গণমাধ্যমকেও দখল করেছেন। এখানে ও তিনি জালিয়াতি ও প্রতারণার পথ অবলম্বন করেছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নাফিজ সরাফতের হাতে তুলে দেওয়া হয় অনলাইন নিউজপোর্টাল নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডট কম এবং ২৫ বছর পর ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে পুনরায় চালু হওয়া দৈনিক বাংলা। দুইটির নিয়ন্ত্রণে জড়িত ছিলেন এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। দৈনিকে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন নাফিজ সরাফতের ভাই চৌধুরী জাফরউল্লাহ সরাফত।
নিউজবাংলা উদ্বোধনের দিনই নাফিজ সরাফত টিভি চ্যানেল আনার ঘোষণা দেন। তবে চ্যানেলটি আনার প্রক্রিয়া এখনো রহস্যময়। ২০১৭ সালে সিটিজেন টিভি নামে একটি চ্যানেলের লাইসেন্স পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান। তবে এটি এখনও সম্প্রচারে আসেনি।
শফিকুর রহমান ২০২২ সালের ৩০ মে এক লিখিত অভিযোগে জানিয়েছেন, ২০১৯ সালে একদিন রাত ১২টার দিকে তাঁকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে ওয়েস্টিন হোটেলে নেওয়া হয়। সেখানে প্রতারণার মাধ্যমে শেয়ার লিখে নেন নাফিজ সরাফত। সঙ্গে ছিলেন পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও আরও কয়েকজন। পরে শফিকুর রহমান জানতে পারেন, শেয়ারবণ্টন হয়েছে এভাবে—তার নামে ৩০ শতাংশ, বেনজীর আহমেদের দুই মেয়ের নামে ৩০ শতাংশ, নাফিজ সরাফতের নামে ২৫ শতাংশ এবং টুটুল নামের একজনের নামে ১৫ শতাংশ।
আওয়ামী লীগের পতনের পর বিভিন্ন দুর্নীতিবিরোধী তদন্তে দেখা গেছে, নাফিজ সরাফতের পরিবারে অন্তত ২৯টি ফ্ল্যাট ও বাড়ি রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার বিরুদ্ধে তদন্তের অংশ হিসেবে এসব সম্পত্তি আদালতের মাধ্যমে জব্দ করেছে। নাফিজ সরাফত, তার স্ত্রী ও ছেলের নামে থাকা ২২টি ফ্ল্যাট, দুটি বাড়ি এবং সব প্লট ও জমির ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন আদালত। ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন দুদকের আবেদনের ভিত্তিতে এই আদেশ দেন।
দুদক ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা ব্যাংকের (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফত, তার স্ত্রী আঞ্জুমান আরা শহীদ ও ছেলে চৌধুরী রাহিব সাফওয়ানের স্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের আবেদন করেন। আবেদনটি করেন দুদকের উপপরিচালক মাসুদুর রহমান। এর পক্ষে যুক্তি দেন দুদকের পিপি মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর। শুনানি শেষে আদালত তাদের নামে থাকা বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট ও জমি ক্রোকের আদেশ দেন।
দুদকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চৌধুরী নাফিজ সরাফতের নামে রাজধানীর গুলশানসহ বিভিন্ন এলাকায় ১০টি ফ্ল্যাট রয়েছে। গুলশান-২ এলাকায় রয়েছে ২০ তলা বিশিষ্ট একটি বাড়ি। পূর্বাচলে তার সাড়ে সাত কাঠা একটি প্লট রয়েছে। এছাড়া গাজীপুর ও বাড্ডায় ২৫ কাঠা জমির মালিকও তিনি। চৌধুরী নাফিজ সরাফতের স্ত্রী আঞ্জুমান আরা শহীদের নামে রাজধানীতে পাঁচটি ফ্ল্যাট রয়েছে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় সাড়ে সাত কাঠা জমির ওপর তার চারতলা বাড়ি রয়েছে। এছাড়া তার নামে আরও ১৩ কাঠা জমির তথ্য উদ্ধার করেছে দুদক। দুটি প্রজন্ম মিলিয়ে চৌধুরী নাফিজ ও আঞ্জুমান আরার ছেলে চৌধুরী রাহিব সাফওয়ানের নামে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সাতটি ফ্ল্যাট ক্রোক করার আদেশ দিয়েছে আদালত।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আদালতকে লিখিতভাবে জানিয়েছে, চৌধুরী নাফিজ সরাফত গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে ৮৮৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এই অভিযোগের তদন্ত এখনও চলছে। দুদকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, চৌধুরী নাফিজ সরাফত, তার স্ত্রী ও ছেলের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে। এসব সম্পত্তি দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে বলে দুদক ধারণা করছে।
পরবর্তীতে দুদক নাফিজ সরাফতের আরও সম্পদের তথ্য পায় এবং সেগুলো জব্দের জন্য আইনি পদক্ষেপ নেয়। দুদকের আবেদনের ভিত্তিতে আরও নয়টি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দেন আদালত। ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন এই আদেশ দেন।

