রাজধানীর অন্যতম আলোচিত বেসরকারি হাসপাতাল আনোয়ার খান মডার্ণ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এ হাসপাতালের নামে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে (এনবিএফআই) ঋণ রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা।
এ বিপুল ঋণের বড় অংশ এখন খেলাপি হিসেবে বিবেচিত। হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনোয়ার হোসেন খান পলাতক রয়েছেন। তিনি একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-১ (রামগঞ্জ) আসন থেকে আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত ছিলেন। আনোয়ার খান মডার্ণ হাসপাতালের সঙ্গে মেডিকেল কলেজ, ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ কয়েকটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান যুক্ত। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের অর্থ আদায় নিয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীদের দুশ্চিন্তা ক্রমেই বাড়ছে। ঋণখেলাপি আনোয়ার হোসেন খানকে খুঁজে না পাওয়ায় ব্যাংকগুলো এখন তার বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে তোলার চেষ্টা শুরু করেছে। তবে নিলামে এসব সম্পত্তি কেনার মতো ক্রেতা সহজে পাওয়া যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও ঋণদাতা ব্যাংকগুলোর তথ্য অনুযায়ী, আনোয়ার খান মডার্ণ হাসপাতালসহ আনোয়ার হোসেন খানের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ঋণের পরিমাণ এখন ৩ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অনাদায়ী সুদ যুক্ত হওয়ার কারণে ঋণের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ রয়েছে শরিয়াহভিত্তিক এক্সিম ব্যাংকে। আনোয়ার হোসেনের কাছে ব্যাংকটির পাওনা ঋণের পরিমাণ ৯৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে বিপদে আছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসিও। ঋণদাতা অন্যান্য ব্যাংক হলো যমুনা ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, এবি ব্যাংক ও শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক। এছাড়া এক ডজনের বেশি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকেও ঋণ নিয়েছেন আনোয়ার হোসেন।
ব্যাংক কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, আনোয়ার হোসেন শুধু নিজের নামে নয়, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বেনামি ঋণও নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি স্ত্রী, শাশুড়ি, শ্যালকসহ কোম্পানির বিভিন্ন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর নাম ব্যবহার করেছেন। নামে-বেনামে নেওয়া ঋণের একটি অংশ তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছেন। সেখানে তার স্ত্রী, কন্যাসহ নিকট আত্মীয় বসবাস করেন। দেশেও নামে-বেনামে তিনি বিপুল জমি, বাড়িসহ সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকাতেই তার ২০টির বেশি বাড়ি রয়েছে। তবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ঋণের জামানত হিসেবে রাখা সম্পত্তির মোট মূল্য ৫০০ কোটি টাকাও হয় না বলে জানানো হয়েছে।
আনোয়ার হোসেন খান বেসরকারি খাতের শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। তিনি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যানসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে ঋণখেলাপির কারণে এখন তিনি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ থেকে বাদ পড়েছেন। ব্যাংকের তিনটি পরিচালক পদের মধ্যে দুটি এখন বিক্রি হয়ে গেছে। আনোয়ার হোসেন খান চতুর্থ প্রজন্মের সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংকের দুটি পরিচালক পদের মালিক ছিলেন।
তবে তার শেয়ার এখন বিক্রি হয়ে গেছে। তার স্ত্রী তাহমীনা আফরোজও এসবিএসি ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। বর্তমানে তিনি ব্যাংকের পর্ষদ থেকে বাদ পড়েছেন কিন্তু আনোয়ার খান মডার্ণ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চেয়ারম্যান পদে থাকা তাহমীনা আফরোজ এখনো তাকাফুল ইসলামী ইন্স্যুরেন্স পিএলসির চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন। আনোয়ার হোসেন খান লুটপাটের শিকার হয়ে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের উদ্যোক্তা পরিচালকদের একজন ছিলেন।
খেলাপি ৩৪৮ কোটি টাকা আদায়ে সম্প্রতি যমুনা ব্যাংক পিএলসি নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। জমি নিলামের জন্য দরপত্র ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখায় জমা দেওয়া যাবে। বিজ্ঞপ্তিতে ধানমন্ডির ৮ নম্বর রোডের ১৮ নম্বর প্লটের ১০ কাঠা জমি নিলামের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। এ জমির পাশেই ১৭ নম্বর প্লটে আনোয়ার খান মডার্ণ হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের অবস্থান। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জামানতের সম্পত্তি বিক্রি করে যমুনা ব্যাংক ১০০ কোটি টাকাও আদায় করতে পারবে না। বর্তমানে এই জমি কেনার জন্য ক্রেতা পাওয়া দায়সাধ্য বলে মনে করা হচ্ছে।
আনোয়ার খান মডার্ণ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেন, “ভালো সময়ে হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে দৈনিক ৭০–৮০ লাখ টাকা আয় হয়। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ আয়কে পরিচালন মুনাফা ধরা যায়। সে হিসাবে হাসপাতালসহ গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালন মুনাফা দিয়ে সর্বোচ্চ ২০০ কোটি টাকার ঋণের কিস্তি পরিশোধ সম্ভব কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোর যে পরিমাণ ঋণ দাঁড়িয়েছে, সেটি অকল্পনীয়। আয় দিয়ে কেয়ামত পর্যন্তও ব্যাংক ঋণ পরিশোধ সম্ভব হবে না।”
দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর মধ্যে একটি হলো ল্যাবএইড। এর প্রধান শাখা ধানমন্ডির ৪ নম্বর সড়কে অবস্থিত, যা আনোয়ার খান মডার্ণ হাসপাতালের কাছাকাছি। ল্যাবএইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ডা. এএম শামীম বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএইচসিডিওএ) সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ডা. শামীম বলেন, “হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ চিকিৎসা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক ঋণ বেশি থাকা উচিত নয়। কারণ এ ধরনের প্রতিষ্ঠান প্রথম পাঁচ-সাত বছরে তেমন মুনাফা করতে পারে না। কোনো হাসপাতালের দৈনিক আয় যদি ৮০ লাখ টাকা হয়, তবে তার সর্বোচ্চ বিনিয়োগ হওয়া উচিত ২৪০ কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতিতে ১২০ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ নেয়া যায়।” তিনি আরও বলেন, “কোনো ব্যক্তির ব্যবসা ও রাজনীতি একসঙ্গে করা ঠিক নয়। বাংলাদেশে বহু ভালো ব্যবসায়ী রাজনীতিতে নামার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আবার অনেক রাজনীতিবিদ ব্যবসায় এসে পরিবেশ নষ্ট করেছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনায় যে নৈতিকতা ও সুশাসন প্রয়োজন, রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পর তা থাকে না।”
আনোয়ার হোসেন খানের স্বাস্থ্য খাতে অস্বাভাবিক উত্থান লক্ষ্য করা গেছে গত দুই দশকে। জানা গেছে, চলতি শতকের শুরুর দিকে তিনি রাজধানীর ফকিরাপুলে একটি ছোট ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ফার্মেসি চালাতেন। ২০০৫ সালে আনোয়ার খান মডার্ণ হাসপাতাল গড়ে তোলেন এবং ২০০৮ সালে আনোয়ার খান মডার্ণ মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১০ সালের আগ পর্যন্ত তিনি নিজেকে বিএনপি সমর্থক হিসেবে পরিচয় দিতেন। কিন্তু এরপর আওয়ামী লীগের নেতা হন। ক্ষমতাশীল দলের শাসনামলে অনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে তিনি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ বের করতে থাকেন। ঋণের একটি অংশ শেয়ারবাজারে খাটান এবং একটি অংশ বিদেশে পাচার করেন। বাকি অর্থ দেশে জমি, বাড়িসহ সম্পত্তি কেনায় ব্যবহার করেন।
২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে হঠাৎ করেই লক্ষ্মীপুর-১ (রামগঞ্জ) আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হন আনোয়ার হোসেন খান। শুরুতে তিনি প্রার্থী ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক তরিকত ফেডারেশন থেকে। আনোয়ার হোসেন খানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঋণদাতা ব্যাংকের একাধিক শীর্ষ নির্বাহী ও শাখা ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগ ঋণ নেওয়া হয়েছে ২০১০ সালের পর থেকে। বিশেষ করে ২০১৮ সালে সংসদ সদস্য হওয়ার পর তার চলাফেরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
তিনি নিজেকে ক্ষমতাশীল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ছেলে’ হিসেবে পরিচয় দিতেন। ব্যাংক ঋণ বের করতে সে সময়ের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলে নূর তাপসের নাম ও ক্ষমতা ব্যবহার করতেন। এছাড়া শেখ পরিবার ও ফজলে নূর তাপসের ব্যবসায়িক অংশীদার এবং ফান্ড ম্যানেজার হিসেবেও নিজেকে পরিচয় করাতেন। ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করে তিনি ব্যাংক নির্বাহী ও কর্মকর্তাদের ধমকাতেন। এর ফলে তার ঋণ গত দেড় দশক ধরে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। এমনকি মেয়াদোত্তীর্ণ হিসাব দেখানোর সুযোগও পাননি ব্যাংকগুলো।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ওমর ফারুক খাঁন জানান, আনোয়ার হোসেনের কাছ থেকে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায়ের চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, “আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই। বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা তাকে খুঁজছি। আমাদের কাছে তার কিছু সম্পদ জামানত আছে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আদায় না হলে ঋণ আদায়ে জামানতের সম্পত্তি নিলামে তোলা হবে।” চেষ্টা সত্ত্বেও আনোয়ার হোসেন খানের নিজস্ব বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। তার ব্যবহৃত দুটি মোবাইল নম্বরই বন্ধ রয়েছে। হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
সম্প্রতি প্রতিবেদক আনোয়ার খান মডার্ণ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে পরিস্থিতি জানতে চাইলেও কোনো কর্মকর্তা নাম উল্লেখ করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে একাধিক কর্মকর্তা জানান, আনোয়ার হোসেন খান এখনো দেশে আছেন। মাঝে মধ্যে রাত ১০টার পর তিনি হাসপাতালে আসেন। এ সময় কঠোর গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়। জনসমাগম এড়িয়ে চলেন তিনি।
একজন কর্মকর্তা বলেন, “হাসপাতালের ব্যবসায়িক পরিস্থিতি একেবারেই ভালো নয়। কিছু ভালো ডাক্তারকে বাড়তি অর্থ দিয়ে হাসপাতালে আনা হচ্ছে। এ ডাক্তারদের নিয়মিত রোগীরাই মূলত এখন হাসপাতালে আসেন। এভাবে হাসপাতালটি কোনো রকমে চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে।”

