ঋণ জালিয়াতিতে আলোচিত সাদ মুসা গ্রুপ আবারও আর্থিক খাতে সক্রিয় হচ্ছে। গ্রুপের কর্ণধার মুহাম্মদ মোহসিন অবৈধ সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থায় তদবির চালাচ্ছেন।
রপ্তানির নামে কাঁচামাল কেনাবেচা দেখিয়ে সাদ মুসা গ্রুপ ১১টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ২ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। এর বাইরে আরও কিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তাদের ঋণ রয়েছে। এসব ঋণ বহু আগে থেকেই খেলাপি হয়ে গেছে। এই কারণে ন্যাশনাল ব্যাংক সাদ মুসাকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ অবস্থায় নতুন ঋণ নেওয়া গ্রুপের পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির মর্যাদা থেকে মুক্তির জন্য সাদ মুসা গ্রুপ তৎপর হয়েছে। ইতিমধ্যেই তারা বাংলাদেশ ব্যাংকে আপিলও করেছে।
তবে সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, ব্যাংক কোম্পানি আইনের আলোকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি থেকে নাম মুছে ফেলা সম্ভব নয়। আইন অনুযায়ী সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ বা সুদ পরিশোধ না করা, জালিয়াতি, প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে ঋণ নেওয়া এবং অন্য উদ্দেশ্যে ঋণ ব্যবহার করাই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞা। সাদ মুসা গ্রুপের বিরুদ্ধে এই সব অভিযোগের প্রমাণ বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে রয়েছে। তাই ন্যাশনাল ব্যাংক তাদের ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে ঘোষণা করেছে। ফলে আপিল করলেও গ্রুপটি অব্যাহতি পাবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ও সহকারী মুখপাত্র শারিয়ার সিদ্দিকী জানিয়েছেন, ব্যাংকের সার্কুলারে চারটি শর্ত আছে। জালিয়াতি, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ না করা, তহবিল স্থানান্তর করা এবং মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে ঋণ নেওয়া—এই চারটির মধ্যে যেকোনো কারণে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণখেলাপি ঘোষণা করা হবে। ব্যাংকের পরিদর্শনে এসব তথ্য উঠে এলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ঘোষণা করবে। এরপর প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আপিল করতে পারবে। তবে জালিয়াতিতে যুক্ত কেউ পুরো ঋণ পরিশোধ না করলে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি থেকে নাম মুছে ফেলা সম্ভব নয়। শোনা গেছে, আপিল চলাকালীন সময়ে নির্ধারিত পরিমাণ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ থাকে।
ঋণখেলাপি সাদ মুসা গ্রুপের কৌশলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সংকটে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংক (এনবিএল)। গ্রুপের অনিয়ম ও খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি এ ব্যাংকের ঋণে। এনবিএলের আগ্রাবাদ শাখায় চারটি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বর্তমানে ১ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা।
চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে সাদ মুসা হোমটেক্স অ্যান্ড ক্লথিংয়ে, যার পরিমাণ ১ হাজার ২১৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এ প্রতিষ্ঠান ২০১৩ সালে ৮০ কোটি টাকা ঋণ পায়। ২০১৬ সালে ঋণের সীমা বাড়িয়ে ৩৩৫ কোটি টাকা আরও দেওয়া হয়। দুই দিনের মধ্যে সব টাকা তোলা হয়। এরপর ব্যবসায় না ব্যবহার করে ২০১৬ সালের ২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর ১৫ কোটি ৪১ লাখ টাকার সমন্বয় করা হয়। একই দিনে ২৮ ডিসেম্বর ঢাকার এমপি প্রয়াত আসলামুল হকের মালিকানাধীন মাহিম রিয়েল এস্টেটের অ্যাকাউন্টে ১৫৯ কোটি টাকা স্থানান্তর হয়।
এই টাকা আসলামুল হকের মাইশা প্রপার্টির ঋণ সমন্বয়ে ব্যবহার করা হয়। মূলত মোহসিন গাজীপুর পৌরসভায় ১৬০০ শতক জমি কেনার জন্য অর্থ নেন। এছাড়া ১৫১ কোটি টাকা পেমেন্ট অর্ডারের মাধ্যমে চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায় সমন্বয় করা হয়। আরোপিত সুদ সমন্বয় ৩ কোটি ১১ লাখ এবং অন্যান্য ব্যাংকে স্থানান্তর করা হয় ৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল বলেছে, ঋণটি যে কারণে নেওয়া হয়েছিল সেই খাতে ব্যবহার হয়নি। ওডি লোন ব্যবসার ওয়াকিং ক্যাপিটাল হিসেবে নেওয়া হলেও তা অন্য খাতে খরচ হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ হলো—এমদাদ এতিম স্পিনিং মিলস ৪৭ কোটি ৬২ লাখ, মাহমুদ সাজিদ কটন মিলস ১৮ কোটি ৭০ লাখ এবং রোকেয়া স্পিনিং মিলস ১৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
গত বছরের ৩০ মে ন্যাশনাল ব্যাংক সাদ মুসা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মোহসিনকে ১৪ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেয়। ব্যাংক জানতে চায়, কেন গ্রুপটিকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ঘোষণা করা হবে না। মোহসিন ২৩ জুন নোটিসের জবাব দেন। তবে ব্যাংকের ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ইউনিট’ তার জবাবকে অসন্তোষজনক হিসেবে বিবেচনা করে। পরবর্তীতে ২ অক্টোবর বিষয়টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৫০৯তম সভায় তোলা হয়। সভায় মোহসিন ও তার প্রতিষ্ঠানগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়।
এবং ১৪ অক্টোবর ন্যাশনাল ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে মোহসিন ও তার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ ঘোষণা করে চিঠি পাঠায়। চিঠিতে বলা হয়, সাদ মুসা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ ঋণ বকেয়া রেখেছে। ব্যাংক অভিযোগ করে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো শর্তাবলি লঙ্ঘন করে তহবিলের অপব্যবহার, বিল জালিয়াতি ও অর্থ স্থানান্তর করেছে। চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, মোহসিনের আর্থিক সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করছেন এবং চট্টগ্রাম আদালতের আদেশও মানছেন না। চিঠিতে নির্দেশ থাকে, যদি মোহসিন বা গ্রুপ এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হন, তবে চিঠি প্রাপ্তির তারিখ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং রেগুলেশন অ্যান্ড পলিসি ডিপার্টমেন্টে আপিল করতে পারবেন। সাদ মুসা গ্রুপ গত বছরের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকে আপিল করে। আপিলের প্রথম শুনানি অনুষ্ঠিত হয় চলতি বছরের ১৫ অক্টোবর। সেই শুনানিতে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মোহসিন অর্থ স্থানান্তরের বিষয়টি স্বীকার করেন।
স্যার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ন্যাশনাল ব্যাংকের চট্টগ্রামের রিজিওনাল ম্যানেজার তৌহিদুল করিম খান বলেন, “সাদ মুসা গ্রুপ টাকা পরিশোধ করলে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি থেকে নাম মুছে ফেলা সম্ভব। ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য কত টাকা দিতে হবে তা নিয়ে সমঝোতা চলছে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি হওয়ায় অন্য ব্যাংকের ঋণও পুনঃতফসিল হচ্ছে না। তাই আগে আমাদের সঙ্গে বিষয়টি সমাধান করতে হবে। এখন পর্যন্ত কোনো টাকা দেননি। কিছু টাকা প্রোপার্টি বিক্রি করে পেয়েছি, তবে তা পর্যাপ্ত নয়।” সাদ মুসা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিনকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে হোয়াটসঅ্যাপে বিস্তারিত মেসেজ পাঠালেও কোনো উত্তর মেলেনি।
পূর্বের তথ্য অনুযায়ী, সাদ মুসা গ্রুপ ব্যাংক থেকে বিপুল ঋণ নিয়ে তা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছেন। ন্যাশনাল ব্যাংকসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন দল গ্রুপকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ঘোষণা করেছে। এ বিষয়ে আপিল করার সুযোগ থাকলেও, সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধ না করা পর্যন্ত গ্রুপের নাম পুনরায় মুছে ফেলা সম্ভব নয়।

