বাংলাদেশে মাদক কেনাবেচা ও অর্থ পাচারের মাত্রায় দেশ বিশ্বে পঞ্চম স্থানে। দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৮৩ লাখের বেশি। দেশি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মাদকের বিস্তার বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবুও বিচারিক প্রক্রিয়ার ত্রুটি ও দুর্বলতার কারণে মাদকের মামলায় ৫৯ শতাংশ আসামি সাজা পাচ্ছেন না। এটি শুধু উদ্বেগজনকই নয়, একই সঙ্গে মাদক নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও বাহিনীর সদিচ্ছার অভাবকেও প্রকাশ করে।
ঢাকাসহ ২৬ জেলার বিভিন্ন আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া ৫০০ মাদক মামলার রায় বিশ্লেষণ করেছে। দেখা গেছে, মাত্র ২০৪টি মামলায়, অর্থাৎ ৪১ শতাংশে সাজা হয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো মূল আসামি—মাদকের পৃষ্ঠপোষক ও অর্থ জোগানদাতারা—প্রায় সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন।
মূল আসামিদের ধরার বদলে শুধু বাহক ও মাদকসেবীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালালে কোনো ফলাফল পাওয়া যায় না। পূর্বের মাদকবিরোধী অভিযানই তার বড় উদাহরণ। এছাড়া, গ্রেপ্তার হওয়া অনেক আসামি সাজা না হওয়ায় পুনরায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
একটি মাদক মামলার অভিযোগপত্রে মূল আসামির নাম উল্লেখ না থাকাও পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গাফিলতির প্রমাণ। তদন্ত সংস্থার ব্যর্থতার পেছনে ১৬ ধরনের ঘাটতি চিহ্নিত হয়েছে। ত্রুটিপূর্ণ এজাহার, নিরপেক্ষ সাক্ষীর অভাব, জব্দ তালিকার ভুল, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার তদারকি না থাকা এবং রাষ্ট্রপক্ষের গাফিলতি এসবের মধ্যে রয়েছে। ফলে মাদক মামলার তদন্ত দায়সারা ও অপ্রতুল হওয়াই স্বাভাবিক। সরকার যাই থাকুক, বছরের পর বছর এই অবস্থা অপরিবর্তিত।
দেশে প্রতিবছর যে সব মামলা হয়, তার মধ্যে মাদক সংক্রান্ত মামলা সবচেয়ে বেশি। জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা মনে করে, বিক্রি হওয়া মাদকের মাত্র ১০ শতাংশই ধরা পড়ে। ২০২৩ সালে ২ কোটি ৩০ লাখ ইয়াবা জব্দ হলেও ২০২৪ সালে তা কমে ২ কোটি ২৮ লাখে দাঁড়িয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা দীর্ঘ সময় ভঙ্গুর থাকার কারণে এই তথ্যের ওপর আশাবাদী হওয়া যায় না।
মাদক প্রতিরোধে নিয়োজিত সংস্থাগুলো কার্যত ‘শর্ষের মধ্যে ভূতের’ ভূমিকা পালন করছে। সফলতার মানদণ্ড হওয়া উচিত—মামলার সংখ্যা, উদ্ধারকৃত মাদকের পরিমাণ এবং আসামির সাজার হার। এই পরিমাপেই স্পষ্ট হয় না মাদক পরিস্থিতির বাস্তব অবস্থা। সংঘবদ্ধ মাদক অপরাধে দায়সারা তদন্ত মানে মূলত অপরাধী চক্রকে পৃষ্ঠপোষকতা করা। মাদকের বিস্তারে জনগোষ্ঠীর সম্ভাবনা নষ্ট হচ্ছে এবং বিভিন্ন অপরাধ বাড়ছে। তাই মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকারকে দৃঢ় অঙ্গীকার দেখাতে হবে।
মাদকের মামলার বিচারে রাষ্ট্রপক্ষকে আরও সক্রিয় হতে হবে। পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে লক্ষ্য ও কর্মপন্থা খুলনলচে পরিবর্তন করতে হবে। তদন্ত সংস্থা ও কর্মকর্তাদের গাফিলতিতে অপরাধীরা পার পেলে, তাদেরও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

