ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) অঞ্চল-১ এর প্রশাসনিক কর্মকর্তা মিজানুর রহমান একই সঙ্গে চারটি অঞ্চলের হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তার দায়িত্বও পালন করছিলেন। মিজানুর লক্ষ্য ছিল উপকর (পৌরকর) কর্মকর্তার পদে পদায়ন, যেখানে অবৈধ আয়ের সুযোগ বেশি।
মিজানুর ধারণা ছিল, এই পদে যেতে হলে ঘুষ দিতে হবে। সেই অনুযায়ী তিনি এক লাখ টাকা ঘুষের প্রস্তাব মোবাইলে প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজকে পাঠান। কিন্তু ফল উল্টো হলো। প্রশাসক ক্ষেপে গিয়ে মিজানুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন। ঘটনাস্থলেই তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় এবং বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। এটি ঘটেছিল ৮ সেপ্টেম্বর।
প্রাথমিকভাবে মিজানুর ভুল বুঝতে পারেননি। পরে তিনি ক্ষমা চেয়েছেন কিন্তু প্রশাসক মাফ দেননি। জানা যায়, এজাজের সময় উপকর পদে ঘুষের হার চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা। তবে এজাজ ঘুষ নিজে নেন না। তিনি মাহবুবুর রহমানের মাধ্যমে ঘুষ সংগ্রহ করেন। মাহবুব এজাজের আত্মীয় হিসেবে পরিচিত। এজাজের সমস্ত লেনদেন ও ঘুষের দরকষাকষি মাহবুবের মাধ্যমে হয়। মাহবুব ঘুষের টাকা সরাসরি এজাজের হাতে দেয় না বরং অন্য একজনের হাতে দিয়ে দেন, যিনি এজাজের অর্থপাচার ও অন্যান্য গোপন কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
প্রশাসক এজাজের হয়ে মাহবুবুর রহমান ডিএনসিসির বিভিন্ন খাত থেকে ঘুষ বাণিজ্য করছেন। আগস্টে এই নিয়ে বড় কেলেঙ্কারি ঘটে। ২৮ আগস্ট রাজধানীর গুলশানে ডিএনসিসির নগর ভবনে বোর্ড সভার সময় কাওরান বাজারের অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ী জোরপূর্বক সভায় প্রবেশ করেন। তারা অভিযোগ করেন, মাহবুব ব্যবসায়ীদের থেকে দোকান দেওয়ার নামে ৫-৬ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন। সভায় উপস্থিত কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য করে তারা বলেন, “মাহবুব আমাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন, এখনও দোকান দেওয়া হয়নি। টাকা ফেরত দিতে হবে এবং মাহবুবের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”
এজাজ ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলেন, ছবি ও নাম দিয়ে প্রমাণ দেখাতে বলেন এবং পরে বিষয়টি দেখার আশ্বাস দেন। ব্যবসায়ীরা সভা শেষে বাইরে চলে যান, তবে পরে আলাদা ব্যবস্থায় তাদের দাবি সমাধান করা হয়।
চলতি বছরের শুরুতে মোহাম্মদ এজাজ প্রশাসক পদে নিয়োগ পান। এই নিয়োগ নিয়ে অনেকেই অবাক হন, কারণ তিনি আগে কখনো আলোচনায় ছিলেন না। এছাড়া তার অতীতও বিতর্কিত। ছাত্রজীবনে তিনি ইসলামি ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন এবং ২০০২ থেকে হিজবুত তাহরীরের সঙ্গে জড়িত। কমপক্ষে দু’বার গ্রেফতার হয়েছেন। তবে নিয়োগের সময় এই অতীত প্রকাশ করা হয়নি। পরিবর্তে তাকে রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়।
এজাজের নিয়োগে এনজিও সূত্রে জানা যায়, উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সুপারিশে স্থানীয় সরকার বিভাগের মাধ্যমে প্রজ্ঞাপন জারি হয়। প্রচার আছে, এজাজ এই পদায়ন পেতে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। প্রশাসক হিসেবে এক বছরের চুক্তিতে তিনি নিয়োগ পান। একশ’ কোটি বিনিয়োগের বিপরীতে তিনি এই বছর হাজার কোটি টাকার লক্ষ্য রাখেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এজাজ মন্ত্রণালয়কেও সন্তুষ্ট রাখতে চেষ্টার পাশাপাশি অবৈধ আয়ের সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে এজাজের অর্থের লোভ বেড়ে যাওয়ায় আইন-কানুন, নিয়মনীতি তিনি মানছেন না। অবৈধভাবে দোকান বরাদ্দ, ফুটপাত বরাদ্দ, মার্কেট নির্মাণ, ই-রিক্সা প্রভৃতি কাজে নজিরবিহীন অনিয়ম ও ঘুষ নেওয়া হচ্ছে। মিজানুর রহমান সরাসরি এজাজকে ঘুষ প্রস্তাব পাঠানোর পেছনের কারণও এটাই।
ডিএনসিসিতে এখন পদায়নে ব্যাপক ঘুষ বাণিজ্য চলছে। শুধুমাত্র নন-ক্যাডার নয়, ক্যাডার কর্মকর্তা পদায়নেও ঘুষের প্রথা শুরু হয়েছে। সম্প্রতি ডিএনসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন মাদারীপুরের উপপরিচালক মুহাম্মদ হাবিবুল আলম। তার আগে তিনি কৃষিমন্ত্রীর প্রটোকল কর্মকর্তা ছিলেন। স্থানীয় সরকার বিভাগের মাধ্যমে তার পদায়ন সম্পন্ন হলেও, প্রশাসক এজাজ নিজে কোনো অর্থ পাননি; উপদেষ্টা সরাসরি পদায়ন নিশ্চিত করেছেন।

