ক্যানসারের মতো ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে চাঁদাবাজি—
বাংলাদেশে একটি সমস্যা সর্বাধিক উদ্বেগজনক—চাঁদাবাজি। দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও এক বিষয়ে সবাই একমত: চাঁদাবাজিমুক্ত পরিবেশ চায়। রাজনৈতিক নেতা হোক বা সাধারণ নাগরিক, সবাই চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কথা বলেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার কেউ আগ্রহী নয়।
চাঁদাবাজদের কাছে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা অসহায়, তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কম। রাজনৈতিক আশ্রয়ের কারণে চাঁদাবাজরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমন পরিস্থিতিতে গোটা দেশের মানুষ চাঁদাবাজদের হাতে নির্যাতিত।
চাঁদাবাজি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে ব্যবসায়ীদের উপর। ক্ষুদ্র, মাঝারি বা বৃহৎ—সব ব্যবসায়ীই এর শিকার। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ইতিমধ্যেই নাজুক। চাঁদাবাজদের দাপট সেই সংকটকে আরো তীব্র করেছে। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, আগে এক স্থানে চাঁদা দিতে হতো- এখন তা দশ স্থানে দিতে হয়। এই দাপট ব্যবসার সকল স্তরে প্রতিদিন অনুভূত হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাঁদাবাজির কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, উৎপাদিত পণ্য সঠিক সময়ে বাজারে পৌঁছাচ্ছে না এবং খুচরা বিক্রেতা থেকে বৃহৎ কোম্পানি—সবাই অর্থনৈতিক চাপের মুখোমুখি।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর কিছু আশার আলো দেখা গেলেও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না আসায় ব্যবসা অনিশ্চয়তার মধ্যে। এই অনিশ্চয়তার মধ্যে চাঁদাবাজি যেন বিষফোড়ার মতো কাজ করছে। সরকারের কঠোর পদক্ষেপ ছাড়া ব্যবসায়ীদের এই দমবন্ধ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি নেই।
পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ এবং বাজারে মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য ব্যবসায়ী শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) মতবিনিময় সভা করেছে। সভায় বলা হয়েছে, পণ্য পরিবহন থেকে খালাস পর্যন্ত চাঁদাবাজি চলছে। ব্যবসায়ীরা একমত যে ট্রাক ওঠানো-নামানো সব ক্ষেত্রে চাঁদা দিতে হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে চাঁদাবাজদের সম্পর্ক বা ‘দহরম-মহরম’ থাকার অভিযোগও নতুন নয়। চাঁদাবাজিমুক্ত পরিবেশ ছাড়া বাজার স্থিতিশীল রাখা অসম্ভব। শুধুমাত্র অনুরোধে সমস্যার সমাধান হবে না; কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রয়োজন।
- কুমিল্লার একটি বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে চাঁদা দিতে বলা হয়; না দিলে তাঁকে স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে চিহ্নিত করার হুমকি দেওয়া হয়। অবশেষে শিক্ষককে অপমানজনকভাবে বিদায় নিতে হয়েছে।
বছরভর ব্যবসায়ীরা চাঁদাবাজদের শিকার। কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা শামসুল হক মণি জানালেন, প্রতিদিন অন্তত ৫০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। দিনে আয় দেড় হাজার টাকা, যার এক তৃতীয়াংশ চাঁদাবাজদের দিতে হয়।
তিনি অভিযোগ করেন, চাঁদাবাজদের কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। এই চিত্র দেশের ফুটপাতের দোকান, কাঁচাবাজার, ছোট বাজার—সব জায়গায় চোখে পড়ে।
মাঝারি ব্যবসায়ীদের অবস্থা আরও শোচনীয়। ট্রাভেল এজেন্সি মালিক আমিনুল বলেন, ৫ আগস্টের পর তাঁর মতিঝিল অফিসে কিছু তরুণ এসে ২০ লাখ টাকার চাঁদা দাবি করেছিল। দিতে না পারায় তিন দিন পর অফিসে হামলা চালানো হয়। থানায় অভিযোগ করলে সাফ বলা হয়েছে, ‘আমাদের কিছু করার নেই’। বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানও নিরাপদ নয়।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, গত ১৫ মাসে ২৭৮টি শিল্পকারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চাঁদাবাজদের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৬৮টি প্রতিষ্ঠান আগুনে ধ্বংস হয়েছে। নীরব চাঁদাবাজিরও প্রভাব ব্যাপক। গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা মুখ খুলতে ভয় পান, কারণ মুখ খুললে বিপদ বৃদ্ধি পায়।
মোহাম্মদপুরে সাধারণ গৃহিণীরা মাসে বাড়িভাড়ার মতো কিশোর গ্যাংদের চাঁদা দিতে বাধ্য। যদি কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকার করে, জীবন বিপন্ন হয়। একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কন্যা হয়রানির শিকার হন। স্থানীয়রা এটাকে নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছেন। পুলিশকে জানালেও বিপদ থেকে মুক্তি নেই।
পরিবহন খাতেও চাঁদাবাজি অব্যাহত রয়েছে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মালিক সমিতির নেতৃত্বও পরিবর্তিত হয়েছে। নতুন নেতৃত্ব চাঁদার রেট বৃদ্ধি করেছে। রাস্তা ও এলাকাভিত্তিক চাঁদাবাজি চালু আছে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাও নিরাপদ নয়।
কুমিল্লার একটি বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে চাঁদা দিতে বলা হয়; না দিলে তাঁকে স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে চিহ্নিত করার হুমকি দেওয়া হয়। অবশেষে শিক্ষককে অপমানজনকভাবে বিদায় নিতে হয়েছে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা জানিয়েছেন, শিক্ষক কখনও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজির কারণে মব সন্ত্রাস চলছে।
এইভাবেই দেশে সব ক্ষেত্রে চাঁদাবাজি চলছেই। ব্যবসায়ী হোক বা সাধারণ মানুষ, কেউই এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। অর্থনীতি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নাগরিক ও ব্যবসায়ীরা একে দুর্বল অবস্থায় মোকাবিলা করছেন।

