ই-কমার্স এখন আধুনিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এক ক্লিকেই পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে দোরগোড়ায়। দ্রুত ডেলিভারি আর আকর্ষণীয় ছাড় যেন জীবনের নতুন স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতীক।
তবে এ আরাম আর আস্থার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক অদৃশ্য ফাঁদ। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সুযোগের দাপটে বুনছে প্রতারণার জাল। তারা নকল পণ্য পাঠায়, ভুল ডেলিভারি দেয় অথবা টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায়। এগুলো এখন আর ব্যতিক্রম নয়, বরং দৈনন্দিন বাস্তবতার অংশ। একটি পরিবার বহু কষ্টে জমানো অর্থ দিয়ে পণ্য অর্ডার করলে যদি প্রতারণার শিকার হয়, তখন শুধু আর্থিক ক্ষতি হয় না। গ্রাহকের মনে গড়ে ওঠে অবিশ্বাস। এই অবিশ্বাসই ধাক্কা দিচ্ছে পুরো ই-কমার্স খাতকে। তবুও প্রশ্ন থেকে যায়—এ প্রতারণার দায় কি শুধুই অসাধু ব্যবসায়ীর, নাকি নীরব ভোক্তা-সংস্কৃতিও এর অংশ?
আজ থেকে পাঁচ বছর আগে ই-কমার্স ছিল এক সম্ভাবনাময় নতুন খাত। তখন প্ল্যাটফর্মের সংখ্যা কম ছিল। তবুও গ্রাহকরা আস্থা রাখতেন। প্রতারণার ঘটনা ছিল বিরল। বর্তমানে চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। অসংখ্য নতুন প্ল্যাটফর্মের ভিড়ে মান নিয়ন্ত্রণ প্রায় অসম্ভব হয়ে গেছে। ক্রেতারা প্রায়ই নকল পণ্য পাচ্ছেন। ফলে ই-কমার্স খাতের ওপর মানুষের আস্থা তলানিতে নেমে এসেছে। বাংলাদেশের ই-কমার্স একসময় ডিজিটাল অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু প্রতারণার কারণে সেই স্বপ্ন আজ আস্থার সংকটে ভুগছে। খাতটির উত্থান ও পতনের পরিসংখ্যান স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে।
২০১৫ সালে বাংলাদেশের ই-কমার্স বাজারের বার্ষিক মূল্য ছিল প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার। তথ্য এসেছে আঙ্কটাডের ডিজিটাল ইকোনমি রিপোর্ট এবং বেসিস ও ই-ক্যাবের যৌথ মূল্যায়ন থেকে। তখন দেশীয় অনলাইন বাণিজ্যে ভোক্তাদের আস্থা ছিল অনেক বেশি। বেসিসের ২০১৫ সালের গ্রাহক-মনোভাব জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৮০ শতাংশ ভোক্তা ব্র্যান্ডেড প্ল্যাটফর্মে নির্দ্বিধায় অনলাইন কেনাকাটা করত। তখন বাজার ছোট হলেও আস্থা দৃঢ় ছিল।
কিন্তু কভিড-১৯ মহামারীর সময় ই-কমার্স দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ২০২০ সালের মধ্যে খাতের আকার বেড়ে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে, যা ১৮০০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নির্দেশ করে। নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ না নেওয়ার ফলে জালিয়াতি চক্রের উত্থান ঘটে। ২০২১ সালে ৫০টির বেশি প্ল্যাটফর্ম, যেমন ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ ইত্যাদির বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার অভিযোগ আসে।
ই-কমার্সের এই উত্থান ও পতনের গল্প প্রমাণ করছে, প্রযুক্তি যতই এগিয়ে যাক না কেন, গ্রাহক আস্থা আর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকলে খাতটি সুরক্ষিত থাকতে পারবে না। ২০২২ সালে বাংলাদেশের ই-কমার্স বাজারের মূল্যমান প্রায় ২ দশমিক ৫ বিলিয়নে উন্নীত হয়। তবে একই সময়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের (ডিএনসিআরপি) ই-কমার্স সংক্রান্ত অভিযোগের সংখ্যা ২০১৯ সালের তুলনায় প্রায় ২৫ গুণ বৃদ্ধি পায়।
একটি জরিপে দেখা যায়, দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ সক্রিয় অনলাইন ক্রেতা একবার হলেও ভুল বা নকল পণ্য পেয়েছেন। এ চরম আস্থাহীনতার কারণে গ্রাহকরা অনলাইন কেনাকাটায় ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’ পদ্ধতিকে প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এর ফলে ডিজিটাল পেমেন্টের ব্যবহার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাজারের আকার প্রায় ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে এবং দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটিরও বেশি। তবু দেশের সামগ্রিক খুচরা বাণিজ্যে ই-কমার্সের অবদান এখনো ৫ শতাংশেরও কম।
মোট ই-কমার্স লেনদেনের প্রায় ৮০ শতাংশই মোবাইল ডিভাইসের মাধ্যমে সম্পন্ন হলেও অনলাইন প্রতারণার ভয় সাধারণ ভোক্তাকে উচ্চমূল্যের কেনাকাটায় পিছিয়ে দিচ্ছে। ই-ক্যাবের বাজার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বহু ক্রেতা এখনো ৫ হাজার ৫০০ টাকার বেশি দামের পণ্য অনলাইনে অর্ডার করতে দ্বিধাবোধ করেন। ডিজিটাল প্রতারণার অভিজ্ঞতা তাদের আস্থাকে ক্রমাগত ভঙ্গুর করে তুলেছে।
এটি প্রমাণ করে, সংখ্যাগত বৃদ্ধি থাকা সত্ত্বেও আস্থার অভাব ই-কমার্স খাতের ভিত্তি দুর্বল করে দিয়েছে। যদি দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে খাতটি তার পূর্ণ সম্ভাবনা (২৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি) অর্জনের বদলে ২০৪০ সালের মধ্যে ১০-১৫ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে স্থবির হয়ে যেতে পারে। এই পরিসংখ্যানগুলো স্পষ্টভাবে দেখায়, ই-কমার্স প্রতারণা শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, বরং দেশের সামাজিক ও জাতীয় উন্নতির পথে একটি বড় অন্তরায়।
এ সমস্যা এখানেই শেষ হয়নি, বরং আরও বিস্তার লাভ করছে। যদি দ্রুত সমাধান না হয়, এর প্রভাব হবে দীর্ঘমেয়াদি। ই-কমার্স খাতের প্রতি মানুষের ক্রমবর্ধমান আস্থাহীনতা শুধু গ্রাহকদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, সমগ্র অর্থনীতিকেও নেতিবাচক প্রভাব দিচ্ছে। নতুন উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন, বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারাচ্ছেন, আর দেশীয় ডিজিটাল অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ছে।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তরুণরা। শিক্ষার্থীদের অনলাইন কেনাকাটা এখন দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু প্রতারণার জালে পড়ে তারা শুধু অর্থনৈতিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না, প্রভাব পড়ছে পড়াশোনায়ও। নতুন ল্যাপটপ বা প্রিয় বই কেনার জন্য জমানো সঞ্চয় এক নিমিষে প্রতারকের হাতে চলে গেলে দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ তৈরি হয়। প্রশ্ন ওঠে—এই ক্ষতি কি শুধু ব্যক্তিগত আর্থিক সীমাবদ্ধ, নাকি সমাজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও প্রভাবিত করছে?
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের দায় শুধু সরকারের নয়। প্রতিটি সচেতন নাগরিকের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এটি একটি সামাজিক আন্দোলন। সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থী, পেশাজীবী, এমনকি স্কুল শিক্ষার্থীরাও যদি সচেতন হন, তবে প্রতারণার জাল ছিন্ন করা সম্ভব। অনেক সময় দেখা যায়, প্রতারণার শিকার মানুষ অভিযোগ করেন না, কারণ মনে করেন এতে লাভ নেই। কিন্তু এটাই সবচেয়ে বড় ভুল। অভিযোগ করা, তথ্য ভাগাভাগি করা এবং সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করা—এসবই সমস্যার সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে।
বর্তমানে কিছু সচেতন নাগরিক ও সংগঠন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করছেন। তারা প্রতারণার শিকারদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরছেন, সঠিক প্ল্যাটফর্ম চেনার উপায় শেখাচ্ছেন এবং প্রয়োজনে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। যদি এই উদ্যোগ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে, তবে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি দুঃখজনক যে, একটি দেশ যখন এগিয়ে যাওয়ার পথে, কিছু অসাধু চক্র সেই পথ বাধাগ্রস্ত করছে। কিন্তু হতাশার মাঝেও আছে আশার আলো। সচেতন সমাজ ও ন্যায়পরায়ণ নাগরিকরাই এ অন্ধকার দূর করতে পারে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ই-কমার্স প্রতারণা শুধুমাত্র বাণিজ্যিক সমস্যা নয়। এটি মোকাবেলায় কেবল আইন প্রয়োগই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সামগ্রিক সচেতনতা। গ্রাহকদের আরও সচেতন হতে হবে এবং প্ল্যাটফর্মগুলোকে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সংবেদনশীল হতে হবে। পাশাপাশি সরকারকে কঠোর নজরদারি এবং দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
যদি আমরা সম্মিলিতভাবে এ সমস্যার মোকাবিলা না করি, ভবিষ্যৎ পরিণতি হবে ভয়াবহ। কিন্তু সঠিক পথে অগ্রসর হলে প্রতারণার সমাধান সম্ভব। এজন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করা জরুরি, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে এবং ডিজিটাল অর্থনীতি তার পূর্ণ সম্ভাবনা নিয়ে বিকশিত হতে পারবে।

