ঢাকার অদূরে সাভারের বিখ্যাত গোলাপ গ্রাম একসময় ছিল রং-সুবাসে ভরা ফুলের রাজ্য। এখন সেই গ্রাম তার পরিচিতি হারানোর পথে। নানা রঙের গোলাপের সুগন্ধ চাপা পড়ে যাচ্ছে একটি আবাসন কোম্পানির আগ্রাসনের নিচে। ‘লেক আইল্যান্ড ঢাকা’ নামের ওই কোম্পানি দখল করে নিচ্ছে বাগান, সরকারি খাসজমি, এমনকি নদী-জলাশয়ও। একের পর এক গোলাপ বাগান কেটে তৈরি হচ্ছে প্লট। উঠছে সাইনবোর্ড। চলছে হরিণ পালনের মতো বেআইনি কার্যক্রমও।
চাষিদের অভিযোগ, নলকূপ উপড়ে ফেলায় পানির অভাবে শুকিয়ে মরছে ফুলের চারা। জমি চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। জীবিকা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ায় প্রায় দুই হাজার চাষি বাধ্য হচ্ছেন পেশা পরিবর্তনে। অথচ ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবসসহ বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে যখন ফুলের চাহিদা বাড়ে, তখনই গোলাপ গ্রাম হারাচ্ছে তার দীর্ঘদিনের সুবাস।
একসময় ঢাকার মানুষের কাছে গোলাপ গ্রাম ছিল ঘুরতে যাওয়ার আদর্শ জায়গা। সুযোগ পেলেই রাজধানীবাসী ছুটে যেতেন সেখানে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে। লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি—বিভিন্ন রং এবং আকৃতির গোলাপের সারি যেন চোখ জুড়িয়ে দিত। মিরিন্ডা গোলাপ, চায়না গোলাপ, ইরানি গোলাপসহ নানা জাতের গোলাপ চাষ হতো এখানে। গোলাপের পাশাপাশি ছিল জারবেরা, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, চন্দ্রমল্লিকাসহ জনপ্রিয় নানা ফুলের চাষ। এখন এসবই প্রায় অতীত।
সরেজমিন দেখা যায়, একসময় সবুজে ভরা এ এলাকা এখন অনেকটাই মরুভূমির মতো। বাগানের জায়গায় চলছে আবাসন প্রকল্পের বিশাল কর্মযজ্ঞ। এক্সক্যাভেটর দিয়ে মাটি কেটে তৈরি করা হচ্ছে গভীর গিরিখাত। সেই মাটি ট্রাকে করে ফেলা হচ্ছে পাশের জলাশয়ে। পরে সেসব জায়গায় গড়ে উঠছে বিভিন্ন আকারের প্লট। পুরো এলাকায় ছড়িয়ে আছে রঙিন সাইনবোর্ড—‘প্লট বিক্রয় চলছে’। হাতে গোনা কয়েকটি বাগান এখনও টিকে আছে, কিন্তু চারপাশের মাটি কেটে গভীর গর্ত করায় সেগুলোতেও চাষ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এক স্থান থেকে মাটি কেটে অন্য স্থানে ফেলতে ফেলতে প্লট বানানোর কাজ চলছে অবিরাম।
প্রবেশমুখে হাতের ডানদিকে বিশাল এক গিরিখাত এখন স্পষ্ট। তার পাশের কয়েকটি বাগানের চারদিকে ১০ ফুটেরও বেশি গভীর গর্ত তৈরি করা হয়েছে। এতে চারা নষ্ট হচ্ছে, ফলন কমছে। গভীর গর্তের কারণে বাগানে ঢোকাই এখন ঝুঁকিপূর্ণ। বর্ষায় এসব জায়গা ছোট জলাশয়ে পরিণত হয়। ফলে বাধ্য হয়েই অনেক চাষি তাদের জমি বিক্রি করে দিচ্ছেন।
স্থানীয় চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘লেক আইল্যান্ড ঢাকা’ প্রথমে বাগানের মাঝখান দিয়ে একটি রাস্তা তৈরি করে। তারপর রাস্তার দুপাশের জমি কিনে মাটি কেটে বড় গর্ত তৈরি করে। এতে আশপাশের জমি চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ে। কেউ জমি বিক্রি করতে না চাইলে তাদের জন্য সৃষ্টি হয় নানা বাধা। চাষিদের অভিযোগ—রাস্তা দিয়ে চলাচলে বাধা দেওয়া হয়, ফুল পরিবহনেও সমস্যা তৈরি করা হয়।
আরও গুরুতর অভিযোগ হলো, কোম্পানিটির নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী রয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, হাকিম ও বারেক নামে দুই জন এই বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। যারা জমি বিক্রিতে অস্বীকৃতি জানায়, তাদের হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়, বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়। চাষিরা মনে করেন, এই চাপে অনেকেই জমি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন।
গোলাপ গ্রাম তাই এখন শুধু ফুলের বাগান হারাচ্ছে না—হারাচ্ছে একসময়ের রঙিন স্মৃতি, স্বপ্ন, আর হাজারো মানুষের জীবিকা।

