শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাল সনদধারী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে। অভিযানে ১১৮৬ জন ভুয়া সনদধারী শিক্ষক শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে চার শতাধিক শিক্ষকের সনদ জাল ও ভুয়া হিসেবে চিহ্নিত, তিন শতাধিক শিক্ষকের সনদ অগ্রহণযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
অধিদপ্তর এসব শিক্ষকের কাছ থেকে বেতন-ভাতা হিসেবে নেওয়া ২৫৩ কোটি টাকা আদায় করার সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেহাত হওয়া ৭৯৩ একর জমি উদ্ধারেও সুপারিশ করা হয়েছে। ডিআইএ সূত্র জানায়, দেড় দশক ধরে জাল সনদ ধরার কার্যকর কোনো অভিযান হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে জাল সনদ ধরা হলেও ঘুষের বিনিময়ে অবৈধভাবে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। নতুন যাচাইয়ে দেখা গেছে, ১২ হাজার ৫০০-এর বেশি আটকে থাকা ফাইলের মধ্যে ১২ জন পরিদর্শক শিক্ষকদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে ভুয়া সনদধারীদের ছাড় দিত। এখন এসব সনদ যাচাই করে ধরা হচ্ছে। একই সঙ্গে ডিআইএ সতর্ক করেছে, অডিটের নামে কোনো কর্মকর্তা যেন অর্থ লেনদেন করতে না পারে।
ডিআইএ সূত্রে জানা যায়, ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জাল সনদ বিরোধী অভিযানে ১ হাজার ১৮৬ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিভাগভিত্তিক সংখ্যা: রাজশাহী ৭৭৯ জন, খুলনা ১৭৯ জন, চট্টগ্রাম ২৪ জন, ঢাকা ৭০ জন। পুলিশ সিটি স্পেশাল ব্রাঞ্চ ১৩৪ জনের তালিকা পাঠিয়েছে। মাদ্রাসা অধিদপ্তর আলাদা তদন্ত করে ১২০ জন শিক্ষকের জাল সনদ বাতিল ও ইনডেক্স কর্তন করেছে।
ধরা পড়া জাল সনদের মধ্যে রয়েছে:
- এনটিআরসিএ শিক্ষক নিবন্ধন
- জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ
- রয়েল ও দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ
- কম্পিউটার প্রশিক্ষণ সনদ (নেকটার)
- বিভিন্ন একাডেমিক সনদ
বিশেষভাবে, চিহ্নিত জাল কম্পিউটার প্রশিক্ষণ সনদ ১৪৮টি ও শিক্ষক নিবন্ধন/এনটিআরসিএ সনদ ১২০টি। বাকি সব বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক সনদ। ডিআইএ কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, সংস্থার প্রধান কাজ হলো স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তর ও সংস্থায় পরিদর্শন ও নিরীক্ষা পরিচালনা করা। পরিদর্শনের শেষে প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেই সুপারিশ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়।
গত এক বছরে সংস্থাটি চার শতাধিক শিক্ষকের জাল ও ভুয়া সনদ চিহ্নিত করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। আরও তিন শতাধিক শিক্ষকের সনদ অগ্রহণযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেহাত হওয়া ৭৯৩ একর জমি উদ্ধারের সুপারিশ, ভুয়া নিয়োগ, অর্থ আত্মসাৎ ও ভ্যাট, আইটিসহ বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের কারণে প্রায় ২৫৩ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত পাঠানোর সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
ডিআইএ পরিচালক অধ্যাপক এম এম সহিদুল ইসলাম জানালেন, সংস্থার মূল কাজ হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক, প্রশাসনিক ও নিয়োগ প্রক্রিয়া ঠিক আছে কি না তা অডিট করা। পাশাপাশি একাডেমিক সুপারভিশন ঠিক আছে কি না তাও দেখা হয়। কিন্তু আগে এই কাজ যথাযথভাবে হয়নি। আমি যোগদান করার পর জাল সনদ ধরতে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছি। সেই অভিযানে চার শতাধিক ভুয়া সনদ ও তিন শতাধিক অগ্রহণযোগ্য সনদ চিহ্নিত করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, এই অভিযান ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। ডিআইএর সুপারিশে এসব শিক্ষকের এমপিও বাবদ নেওয়া বেতন-ভাতা ফেরত নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এখন নিয়ম অনুযায়ী চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করার আগে সব শিক্ষাগত সনদ যথাযথভাবে যাচাই করা উচিত। কিন্তু জাল সনদ ধরা পড়ার পরও কিছু অসাধু কর্মকর্তা অবৈধ সুবিধা নিয়ে বিষয়টি চেপে রেখেছেন। এর ফলে জাল সনদধারীরা এমপিওভুক্ত হয়ে সরকারি বেতন-ভাতা পেতে থাকেন। তবে এনটিআরসিএর মাধ্যমে অনলাইনে সনদ যাচাইয়ের ব্যবস্থা শুরু করার পর জাল সনদের হার কিছুটা কমেছে।
মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক বি এম আব্দুল হান্নান বলেন, “যদি একজন শিক্ষক জাল সনদে চাকরি নেন, তিনি শুধু সরকারের সঙ্গে প্রতারণা করেন না, পুরো চাকরি জীবনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করেন। এসব শিক্ষককে ধরতে আমরা ডিআইএর সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।” শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব (নিরীক্ষা ও আইন) জহিরুল ইসলাম জানান, জাল সনদধারীদের তালিকা শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। তালিকাভুক্ত শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি ও নিয়োগ বাতিল করা হবে। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এমন কাজ করার সুযোগ না পায়।
অতিরিক্তভাবে, সংশ্লিষ্ট সূত্র জানাচ্ছেন, ডিআইএতে জাল সনদধারী শিক্ষকদের ফাইল আটকে রেখে একটি বাণিজ্য চলতো। কয়েকজন পরিদর্শক সিন্ডিকেট গঠন করে জাল সনদের নামে এই জালিয়াতিতে যুক্ত ছিলেন। সিন্ডিকেটের মধ্যে ছিলেন সাবেক পরিদর্শক ড. এনামুল হক ও মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম মাসুম (২৪তম বিসিএস), পরিদর্শক কে এম শফিকুল ইসলাম, মনকিউল হাসানাত, দেলোয়ার হোসেন, শাহিনুর ইসলাম, সাদিয়া সুলতানা, আশরাফুল রহমান খান, রিপন মিয়া, সরকার মোহাম্মদ শফিউল্লাহ দিদার, কামরুন নাহার ও মোহাম্মদ ওয়ায়েছ আলকারনী মুন্সী। তারা প্রায় সাড়ে ১২ হাজার ফাইল আটকে রেখেছিলেন, যার বেশিরভাগই ছিল ভুয়া সনদধারী শিক্ষকদের। এই ফাইল নতুন করে যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে বেরিয়েছে জালিয়াতির ভয়াবহ চিত্র।
ডিআইএ পরিচালক অধ্যাপক এম এম সহিদুল ইসলাম জানান, “একটি দপ্তরে প্রায় ১২ হাজারের বেশি ফাইল অনিষ্পত্তি অবস্থায় ছিল। এখন সেই ফাইল যাচাই করতে গিয়ে দেখা গেছে, বেশিরভাগই জাল সনদ সংক্রান্ত। এসব ফাইলের মধ্যে কী হয়েছিল, তা বোঝা যায়।”
পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সবাইকে সতর্ক করেছে। এক গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ডিআইএ-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত অফিস আদেশ ছাড়া কোনো পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না। এছাড়া এ ধরনের কাজের জন্য অর্থ লেনদেন সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।
ডিআইএ জানিয়েছে, তারা সব সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত পরিদর্শন ও নিরীক্ষা চালিয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করে। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান প্রধান বা অন্য ব্যক্তি পরিদর্শন ও নিরীক্ষার নামে অর্থ দাবি করে, তাহলে তা লিখিতভাবে মোবাইল বা ইমেইলে অধিদপ্তরে অভিযোগ জানাতে বলা হয়েছে। অভিযোগ তথ্য প্রদানকারীর পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন রাখা হবে।

