নরসিংদীর রায়পুরা এলাকার চানপুর। ১০ অক্টোবরের রাত তখন গভীরতার দিকে এগোচ্ছে। মধ্যরাত পেরিয়ে দেড়টার কিছু আগে মেঘনা নদীর বুকে ছুটে চলা একটি সারবোঝাই বাল্কহেডে হঠাৎই হামলে পড়ে অস্ত্রধারী একদল ডাকাত। তারা সার পরিবহনকারী প্রতিষ্ঠানের এসকর্ট শামীমকে (৪১) অস্ত্রের মুখে আটকে জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এরপর তার হাত-পা বেঁধে ট্রলারে তুলে ফেলে নদীতে নিক্ষেপ করা হয়।
সৌভাগ্যক্রমে শামীম পরে প্রাণে বেঁচে যান, তবে বাল্কহেডে থাকা নাবিক ও শ্রমিকদের জন্য রাতটি হয়ে ওঠে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তায় ভরা।
বাল্কহেডটিতে ছিল ৬ হাজার ৩৪০ বস্তা সার, যা পরে নৌ পুলিশের অভিযানে উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনাই শুধু নয়, সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক পণ্যবাহী নৌযানে এভাবে হামলা চালাচ্ছে জলদস্যুরা। আগে যেখানে সমুদ্র বা ভরা নদীতে এ ধরনের আক্রমণের খবর পাওয়া যেত, এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে তীরসংলগ্ন জলসীমা, এমনকি জনবহুল এলাকার পাশের নদীপথেও। নৌপথ, যেটি একসময় তুলনামূলক নিরাপদ মনে করা হতো, এখন হয়ে উঠছে ঝুঁকিপূর্ণ।
নৌ পুলিশের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা এবং ডাকাতদের হামলার শিকার নৌযানের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব জলদস্যুর বড় অংশই পরিচিত নৌ শ্রমিক। দিনের কাজ শেষে রাত নামলেই অনেকে রূপ বদলে ডাকাতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ সোর্স হিসেবে নৌযানের অবস্থান বা পণ্যের তথ্য সরবরাহ করে। আবার নৌ পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করতে করতে ভয়ংকর ডাকাত দলে পরিণত হওয়ার ঘটনাও আছে।
নৌ পুলিশের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, শ্রমিকের বেশে থাকা এই দস্যুরাই বর্তমানে বড় উদ্বেগের কারণ। এ পরিস্থিতিতে নৌ শ্রমিকদের ডাটাবেজ তৈরির জন্য নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়কে একাধিকবার অনুরোধ করা হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর নৌপথে অন্তত ১৬১টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে কমপক্ষে ১১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। গড়ে প্রতি মাসে প্রায় ১৪টি ডাকাতি হচ্ছে।
মেঘনা–শীতলক্ষ্যা–পুরোনো ব্রহ্মপুত্র: সক্রিয় ১৪ ডাকাত দল-
মালপত্র পরিবহনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় মেঘনা, শীতলক্ষ্যা ও পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদ। নৌ পুলিশের ঢাকা রিজিওন এই তিন নদীতে সক্রিয় ১৪টি ডাকাত দলকে চিহ্নিত করেছে।
সংশ্লিষ্ট থানাসূত্রে জানা গেছে, এসব দলের হোতা এবং অধিকাংশ সদস্যই পেশায় নৌ শ্রমিক। দিনের কাজ শেষে সুযোগ বুঝে রাতের অন্ধকারে তারা ডাকাতিতে অংশ নেয়। এই দলে রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রতন মিয়া (৩৬), নবীনগরের জামাল মিয়া (৫০), নরসিংদীর শিমুল মিয়া (৩৪), ভান্ডারুর জুলহাস ওরফে বিল্লাল (৩৮), আশুগঞ্জের লোকমান (৩৬), মাদারীপুরের আব্দুস সোবহান ঢালী (৩৫), সাদ্দাম (৩০), কামাল খাঁ (৪২), ফরিদ হাওলাদার (৪৮), কালু হাওলাদার (৩৯), বাগেরহাটের আনোয়ার হোসেন (৬০), গজারিয়ার আক্তার (৪৮), শরীয়তপুরের দেলোয়ার খলিফা (৪০) এবং নরসিংদীর হান্না ওরফে হান্নানের দল। তাদের হয়ে অন্তত ৫০ জন নিয়মিত ডাকাতিতে অংশ নেয়, আবার অনেকে একেক অপারেশনে চুক্তিভিত্তিক কাজ করে।
নৌ পুলিশের ঢাকা অঞ্চলের পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, রায়পুরার মেঘনা নদীতে সাম্প্রতিক সারবোঝাই বাল্কহেড ডাকাতির ঘটনায় গ্রেপ্তার চারজনেরই নৌপরিবহন শ্রমিক হিসেবে কাজ করার রেকর্ড আছে। তাদের মধ্যে অনেকেই শ্রমিক পরিচয় ব্যবহার করে রাতের বেলা ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়ে।
সোর্স থেকে সর্দার—জলদস্যু আলমগীরের উত্থান-
নরসিংদীর পঞ্চবটি গ্রামের আলমগীর একসময় সাধারণ নৌ শ্রমিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কাজের সুবাদে নৌ পুলিশের সঙ্গে সখ্য তৈরি হয় এবং ধীরে ধীরে পুলিশ সোর্স হিসেবে কাজ শুরু করেন। সময়ের সঙ্গে সেই সখ্য ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মেঘনা, শীতলক্ষ্যা ও পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের জলপথে কার্যত ‘মুকুটহীন সম্রাট’ হয়ে ওঠেন তিনি। প্রথমে পুলিশের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন নৌযান থেকে চাঁদাবাজি শুরু করেন, পরে পরিচিত আরো কয়েকজন শ্রমিককে নিয়ে তৈরি করেন ভয়ংকর ডাকাত দল। ১০ অক্টোবরের বাল্কহেড ডাকাতিতে অংশ নেওয়ার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার নামে ডাকাতি ও হত্যাচেষ্টাসহ অন্তত আটটি মামলা থাকলেও এবারই প্রথম ধরা পড়লেন।
মির্জারচর নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আবদুর রব বলেন, রিমান্ডে আলমগীর কীভাবে শ্রমিক থেকে ডাকাত সর্দার হয়ে উঠল, সে সম্পর্কে বহু তথ্য দিয়েছে। সেগুলো যাচাই চলছে।
সারবোঝাই জাহাজে হামলার ঘটনাটি কীভাবে ঘটেছিল-
১০ অক্টোবর রাত দেড়টার দিকে নরসিংদীর চানপুর এলাকায় মেঘনার জলে থাকা সারবোঝাই বাল্কহেডে অকস্মাৎ হামলা চালায় ডাকাতরা। এসকর্ট শামীমকে প্রথমে হাত-পা-মুখ বেঁধে বাল্কহেডের কোণায় একটি পর্দাঘেরা কক্ষের ভেতর ফেলে রাখা হয় ভোর পর্যন্ত। পরে তাকে ট্রলারে তুলে নেওয়া হয়। ট্রলারচালককে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, ৬ হাজার টাকার বিনিময়ে সন্ধ্যার পর তাকে নদীতে ফেলে দেওয়া হবে। শামীম বলেন, ভাগ্যের জোরে তিনি বেঁচে ফিরেছেন। তার দাবি, যারা তাদের মাল পরিবহন করছিল, তারাই মূলত ডাকাত। আলমগীর নিজেকে মালিক পরিচয় দিয়ে পুরো পরিকল্পনা সাজিয়েছিলেন।
নৌ পুলিশ জানায়, ঘটনার পরপরই মামলা হয়, দুই দিনের মাথায় উদ্ধার হয় বাল্কহেড ও সার। গ্রেপ্তার হয় আলমগীরসহ সুকানি জসিম, ইঞ্জিন মিস্ত্রি আব্দুর রহিম এবং ট্রলারচালক সাকিম। জিজ্ঞাসাবাদে সাকিম জানান, নৌ শ্রমিক নাঈম তাকে জানায় যে বাল্কহেডে “একটা বস্তা” আছে, যাকে সারাদিন নদীতে ঘুরিয়ে সন্ধ্যায় নদীতে ফেলে দিতে হবে—আর এজন্য তার সঙ্গে ৬ হাজার টাকার চুক্তি হয়।
এর আগে ৭ জুলাই মুক্তারপুর থেকে ছেড়ে যাওয়া সিমেন্টবোঝাই আরেক বাল্কহেডও ‘ডাকাতির’ কবলে পড়েছিল। পরে তদন্তে জানা যায়, ওই ঘটনার নেপথ্যে ছিল বাল্কহেডের সুকানি আক্তার ও মিস্ত্রি বেল্লাল। তারা নিজ গন্তব্যে না গিয়ে অপহরণ নাটক সাজিয়ে মালিকের কাছে ১০ লাখ টাকা দাবি করে। পুলিশ দুইজনকে গ্রেপ্তার করে এবং জাহাজ উদ্ধার করে।
এক বছরে প্রাণহানি ১১-
সেভ দ্য রোডের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর নৌপথে ১৬১টি ডাকাতির ঘটনায় অন্তত ১১ জন প্রাণ হারান। সংগঠনটির মহাসচিব শান্তা ফারজানা বলেন, নৌপথে ডাকাতি ক্রমেই বাড়ছে, আর নৌ শ্রমিকদের কেউ কেউ এসব ঘটনায় যুক্ত থাকায় পরিস্থিতি আরো উদ্বেগজনক।
নৌ পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক কুসুম দেওয়ান বলেন, নৌ শ্রমিকদের একটি অংশের ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়া শঙ্কাজনক। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে এবং নৌ শ্রমিকদের তথ্যভান্ডার তৈরির প্রস্তাব করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, কোটি টাকা ব্যয়ে নৌযান কেনা হলেও তাতে সিসিটিভি বা লোকেশন ট্র্যাকার থাকে না। এগুলো বাধ্যতামূলক করা গেলে ডাকাতি অনেকটাই কমে আসবে।

