দেশে ফেনসিডিলের পাশাপাশি একই ধরনের আরও তিনটি নতুন নেশাজাতীয় সিরাপ ছড়াতে চাইছে ভারতের মাদক কারবারিরা। ভারতের সীমান্তঘেঁষা ১০ জেলার কারখানায় এসব সিরাপ তৈরি হচ্ছে। আটটি সীমান্ত জেলা দিয়ে সেগুলো বাংলাদেশে ঢুকছে। ইতিমধ্যে ছোট কয়েকটি চালান আটকও হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, নতুন এসব সিরাপ এখন তাদের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ।
সংশ্লিষ্টদের তথ্য, জাতীয় নির্বাচন ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যস্ততার সুযোগ নিতে চাইছে কারবারিরা। তারা বড় চালান পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। এসব সিরাপেও রয়েছে কোডিন ফসফেট। ফেনসিডিলের মতোই বোতলজাত করে পাঠানো হচ্ছে। দেশেমুখী পথ বন্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, নতুন তিন নেশাজাতীয় সিরাপ হলো ‘ব্রনোকফ সি’, ‘চকো প্লাস’ ও ‘উইন কোরেক্স’। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের নাম ব্রনোকফ সি। কাশির ওষুধ হিসেবে তৈরি হলেও নেশাজাতীয় উপাদান থাকার কারণে সিরাপগুলো ভারতে নিষিদ্ধ। নাম নতুন হলেও নেশার মাত্রা ফেনসিডিলের সমান। অনেক জায়গায় ফেনসিডিলের বোতলেই নতুন লেবেল লাগিয়ে পাঠানো হচ্ছে। এর আগে ‘এস্কাফ’ সিরাপও একইভাবে দেশে এসেছিল।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের জরিপ বলছে, দেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৮৩ লাখ। বেশির ভাগই পুরুষ। নারী ও শিশুও বাদ নয়। ফেনসিডিল ও সমজাতীয় মাদকে আসক্ত অন্তত ৩ লাখ ৪৬ হাজার মানুষ।
অধিদপ্তরের চিকিৎসা অধিশাখার তথ্য, এসব সিরাপ সেবনে গলা শুকিয়ে যায়। ঝিমুনি ধরে। লিভার ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘমেয়াদে পুরুষের প্রজননক্ষমতা কমে যায়।
সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানায়, ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগনা, নদীয়া, মালদা, মুর্শিদাবাদ, ত্রিপুরার পশ্চিম–দক্ষিণাঞ্চল, সিপাহীজলা, বিলোনিয়া, শান্তির বাজার এবং মেঘালয়ের একটি জেলায় অন্তত ৬২টি কারখানায় নতুন তিন সিরাপ তৈরি হচ্ছে। এসব কারখানাকেন্দ্রিক ৩৭৪ ভারতীয় কারবারি মাদক চোরাচালানে জড়িত। তারা সিরাপ পাঠাচ্ছে সাতক্ষীরা, যশোর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্ত দিয়ে।
অধিদপ্তর জানায়, কারখানাগুলোর পরিচয়, অবস্থান, রুট এবং জিরো লাইন পর্যন্ত সব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এগুলো ভারতকে রাষ্ট্রীয়ভাবে জানিয়ে কারখানা বন্ধে সুপারিশ করা হবে। পাশাপাশি সীমান্ত এলাকায় পুলিশ ও বিজিবিকে সতর্ক করা হবে। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, ভারতের কাছে তালিকা দিলে অতীতে খুব একটা ফল পাওয়া যায়নি।
অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিন সিরাপের মধ্যে ‘ব্রনোকফ সি’ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। রাজশাহীর চারঘাট ও দামকুড়া এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে এটি বেশি ঢুকছে। সহজে পাওয়া যাওয়ায় তরুণদের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। নির্বাচন সামনে রেখে বাহিনীর নজর কমলে পাচার বাড়তে পারে—এমন আশঙ্কাও রয়েছে।
বগুড়া কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহা. জিললুর রহমান বলেন, নাম যাই হোক—ফেনসিডিল, ব্রনোকফ সি, চকো প্লাস বা উইন কোরেক্স—এসবের মূল উপাদান একই। তাই সীমান্তেই নিয়ন্ত্রণ জরুরি। সীমান্তে থামাতে পারলে দেশের ভেতরে নিয়ন্ত্রণ অনেক সহজ হয়। তিনি জানান, ভারতের ল্যাবোরেট ফার্মাসিউটিক্যালস এই সিরাপ তৈরি করে। নেশাজাতীয় উপাদান থাকার কারণে ভারতে নিষিদ্ধ হলেও উৎপাদন বন্ধ হয়নি।
গোয়েন্দা তথ্য বলছে, চারঘাটের ইউসুফপুর, দামকুড়ার মুরারীপুর এবং শিবগঞ্জের কয়েকজন ব্যবসায়ী ব্রনোকফ সি আনা–নেওয়ার সঙ্গে জড়িত। অনেক আইনশৃঙ্খলা সদস্য এখনো সিরাপটি চেনেন না। তাই পাচারকারীরা সহজে সীমান্ত পার করছে। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে অধিদপ্তর।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ সীমান্তে ৩ ডিসেম্বর চকো প্লাসের একটি চালান আটক করে বিজিবি। মহানন্দা ব্যাটালিয়ন টহল বাড়িয়ে ১৫০ বোতল উদ্ধার করে। গত এক মাসে অন্তত ২০০ বোতল আটক হয়েছে। এর আগে এই সীমান্তে চকো প্লাস জব্দ হয়নি।
বিজিবির মহানন্দা ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম কিবরিয়া বলেন, মাদকবিরোধী অভিযানে বিজিবি জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছে। নতুন মাদক নিয়েও তারা সতর্ক রয়েছে।
সূত্র বলছে, যশোরের শার্শা ও বেনাপোল দিয়ে ‘উইন কোরেক্স’ সবচেয়ে বেশি ঢুকছে। নভেম্বরের প্রথম ১০ দিনে বিজিবি ৮৫০ বোতল জব্দ করেছে। ফেনসিডিল যেখানে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা, সেখানে উইন কোরেক্স বিক্রি হচ্ছে ৮০০–৯০০ টাকায়। আকার ও বোতল একই হওয়ায় তরুণদের আগ্রহ দ্রুত বাড়ছে। অভিযোগ আছে, নেশার মাত্রা বাড়াতে অনেক সময় সিরাপের সঙ্গে প্যাথেডিনও মেশানো হয়। এতে এটি আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ নয়। তবুও নানা ধরনের মাদক ছড়িয়ে পড়েছে। ওষুধের আড়ালে নতুন সিরাপ ঢুকতে থাকলে নজরদারি না বাড়ালে তরুণদের মধ্যে আসক্তি বাড়বে। এতে দেশের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

