হাজার কোটি টাকার মালিক, কিন্তু তা শ্রম বা স্বার্থসিদ্ধির মাধ্যমে নয়। সবই এসেছে ‘উত্তরাধিকার ক্ষমতায়’। প্রথমে বিষয়টি অস্বাভাবিক মনে হলেও এমনই ঘটনা ধরা দিয়েছে ঢাকা-১৬ আসনের সাবেক এমপি মো. ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লার চাচাতো ভাই জুয়েল মোল্লার ক্ষেত্রে।
সরকারি ১২ একর জমির পাশাপাশি সাধারণ মানুষের দুর্বল ও কম ক্ষমতাসম্পন্ন জমি দখল করে তিনি গড়ে তুলেছেন সাগুফতা হাউজিং সাম্রাজ্য। এসব জমি পরে বিক্রি করেছেন বিভিন্ন হাউজিং কোম্পানি যেমন—এশিউর, সানভিউ, হ্যাভেলি প্রোপার্টিজ, সিটি লাইফ, আরকে টাওয়ার প্রোপার্টিজ এবং প্রায় আড়াইশ ব্যক্তির কাছে। এর মাধ্যমে জুয়েল মোল্লা হাতিয়েছে হাজার কোটি টাকা।
রাজধানীর মিরপুর ও পল্লবী থানার বারনটেক, বাইগারটেক, হাজী মার্কেট ও আজিজ মার্কেট এলাকায় বাসিন্দারা জিম্মি ছিলেন এই কোম্পানির মালিক জুয়েল মোল্লার কাছে। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এমপি বড় ভাই ইলিয়াস মোল্লার দাপটে জুয়েল রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ গড়েছেন।
সরকারি (সিএস দাগ নং-৩১২৪) জমি দখল এবং সাধারণ মানুষের জমি কেনার নামে তিনি গড়ে তুলেছেন সাগুফতা হাউজিং। নিজের কবজায় রাখতে আলাদা আইনজীবী রেখেছেন, রয়েছে নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনীও। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে ভুক্তভোগীদের মারধর বা হত্যার হুমকি দেওয়া হতো। এমনকি হত্যার মতো ঘটনা ঘটার খবরও পাওয়া গেছে।
এ পর্যন্ত প্রায় ২০০ ভুক্তভোগী আইনি প্রতিকার চেয়েছেন। থানায় সাধারণ ডায়েরি ও ২০টি মামলা করা হলেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা হয়নি। প্রশাসনকে নিজেকে অধরা রাখার মাধ্যমে যেন নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। ৪০ জন ভুক্তভোগী সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দিলেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি।
সাগুফতা হাউজিংয়ের দখলবাজির শিকার বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কেউ কথা বলার সাহস পান না। প্রতিষ্ঠানটির মালিক জুয়েল মোল্লা সাবেক এমপি মো. ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লার চাচাতো ভাই। ভুক্তভোগীরা বলেন, ইলিয়াস মোল্লার ক্ষমতার অপব্যবহার করে জুয়েল মোল্লা ও তার সহযোগীরা ‘যা খুশি তাই করতেন’। প্রতিষ্ঠানটিকে আওয়ামী লীগের কোম্পানি হিসেবে প্রচার করা হতো। এজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সরকারি দপ্তর, থানা এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। উল্টো প্রতিকার চাওয়ায় পরে আরও বেশি নির্যাতনের শিকার হতে হতো। এমনকি অনেকের জমি নামমাত্র মূল্যে লিখে দিতে হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সরকারি অধিগ্রহণ করা জমি হলেও দায়িত্বশীল দপ্তরগুলোর নজর না থাকায় বিভিন্ন হাউজিং কোম্পানি রাজধানীর মিরপুরের বাউনিয়া এলাকায় ৩১২৪ নম্বর দাগের ১৪.৫৮ একর জমি দখল করেছে। এর মধ্যে সাবেক এমপি ইলিয়াস মোল্লার প্রভাব ব্যবহার করে জুয়েল মোল্লা সাগুফতা হাউজিংয়ের মাধ্যমে ১২ একর দখল করেন। পরে এই জমি হ্যাভেলি, এশিউর, এন এম হাউজিং লিমিটেড, সানভিউ টাওয়ার্স, আর কে টাওয়ার প্রোপার্টিজ, সিটি লাইফ প্রোপার্টিজ এবং মো. আবু বক্করসহ বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যক্তির কাছে বিক্রি করা হয়।
সাগুফতা হাউজিং ছোট ছোট প্লটও তৈরি করে বিক্রি করেছে। মূলত ২০০৮ সালের পর সাবেক এমপি ইলিয়াস মোল্লারের ক্ষমতায় জুয়েল মোল্লার কোম্পানি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। দখল করা জমিতে একাধিক বহুতল ভবন নির্মাণ করে ফ্ল্যাট বিক্রি করা শুরু করে তারা। তাদের দেখাদেখি আরও কয়েকটি কোম্পানি একইভাবে দখল করা জমিতে ভবন তুলে ফ্ল্যাট বিক্রি করে।
দখল পাকাপোক্ত করতে সামরিক বাহিনী, পুলিশ কর্মকর্তা ও আমলাদের কাছে জমি ও কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করা হয়। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে নামমাত্র মূল্যেও জমি লিখে দেওয়া হয়। এছাড়া প্রশাসনের সাবেক কিছু কর্মকর্তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়ে প্রশাসনিক প্রভাব বাড়ানো হয়, যার ফলে অবৈধ দখল ও বহুতল ভবন নির্মাণের কার্যক্রম এখনও চালু রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (রাজউক) ‘কজ্জায়’ রেখে এসব হচ্ছে। সম্প্রতি জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ (জাগৃক) সরকারি জমি উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করেছে এবং গত অক্টোবর রাজউককে চিঠি দিয়ে এসব দখলদার কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানায়। তবে সংস্থাটি এখনও নীরব।
অভিযোগ রয়েছে, জাগৃকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে জাল কাগজপত্র তৈরি করে এসব জমি দখল করা হয়েছে। এর ফলে সরকারি জমি দখল ও অবৈধ বহুতল নির্মাণের বিষয়ে কর্মকর্তারা সচেতন হয়ে চুপ থাকেন। প্রতিকার চাওয়া তো দূরের কথা, মন্ত্রণালয় বা কোনো সংস্থাকে জানানোর পর ভুক্তভোগীরা মারধর বা প্রাণের ঝুঁকির শিকার হতে হতো।
রাজধানীর মিরপুরের ৩১২৪ নম্বর দাগের সরকারি জমিতে সাগুফতা হাউজিং বেশ কিছু বহুতল আবাসিক ভবনের নকশা অনুমোদন নিয়েছে। রাজউকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠানটি রোজ গার্ডেন টাওয়ার নামে ১৩ তলা (এ-২ টাইপ) ইমারতের নকশা অনুমোদন পায়। তবে কাজ চলাকালীন নির্মাণকাজ রাজউক বন্ধ করে দেয়। পরে ভবন মালিক আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেন, যার নম্বর-১৩২৪/২৪। সিএস দাগ নম্বর-৩১২৪-এ সাগুফতা হাউজিং নীহারিকা টাওয়ার নামে আরেকটি ১৩ তলা আবাসিক ইমারতের নকশা অনুমোদন নেয়। প্রথম তলার কাজ চলাকালীন নির্মাণ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এছাড়া সাগুফতা এনএম হাউজিং লিমিটেড আরও ৯ কাঠা ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি দখল করেছে। এগুলো হলো—মো. মঞ্জুর উল হকের প্লট নম্বর ৩৮৬৪, ব্লক-এল (৩ কাঠা), মো. শহীদ উল হকের প্লট নম্বর ৩৮-৩৯, ব্লক-এল (৩ কাঠা), এবং মো. লুৎফুল হাবিবের প্লট নম্বর ৩৮৬৫, ব্লক-এল (৩ কাঠা)। এসব জমির বাজারমূল্য প্রায় ৬ কোটি টাকা। জমির মালিকরা গৃহায়ন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে বিষয়টি জানিয়েছেন।
জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মিরপুর বিভাগীয় নির্বাহী প্রকৌশলী-২ আবু হোরায়রা বলেন, “৩১২৪ নম্বর দাগের ১৪.৫৮ একর জমি বিভিন্ন কোম্পানির দখলে ছিল। এসব জমিতে কোনো কোনো কোম্পানি বহুতল ভবন ও প্লট তৈরি করে বিক্রি করেছে। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ এ জমি উদ্ধার করেছে।”
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সানভিউ টাওয়ার্স কোম্পানি সমিতির সভাপতি মো. সাইফুল বলেন, “আমরা কোনো সরকারি জমি দখল করিনি। আমাদের কোম্পানির যে জমি আছে, তার দুই জায়গায় ১ একর ১ শতাংশ জমি আছে। এসব জমির ৬০ শতাংশ আমরা সাগুফতা থেকে কিনেছি। জমির কাগজপত্র আমাদের কাছে আছে।” সার্বিক বিষয়ে বক্তব্য নিতে জুয়েল মোল্লাকে হোয়াটসঅ্যাপ ও কল করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি। পরবর্তী বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি। সূত্র: কালবেলা

