মনিকা, সেলিনা, মুক্তা, হিরা ও মানিক—পাঁচজনই আপন ভাই–বোন। তাঁদের স্বামী বাহার উদ্দিন রকি ওরফে রনি, সালাউদ্দিন, হযরত আলী ও ইব্রাহিম একসময় জীবিকার সন্ধানে চট্টগ্রামে আসেন। কেউ ভ্যান চালাতেন, কেউ দিনমজুরের কাজ করতেন। কয়েক শ টাকা ভাড়ায় বস্তিতে বসবাস ছিল তাঁদের ঠিকানা। সময়ের ব্যবধানে সেই পরিবারের সব নাম এখন পুলিশের খাতায় তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে।
মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে তাঁরা সবাই একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করেছেন। মাদক বিক্রির টাকায় এখন চট্টগ্রাম শহরে দালান তুলে ভাড়া দিয়ে চলছে তাঁদের জমিদারি। তবে যে জমিতে এসব স্থাপনা, তা তাঁদের নিজস্ব নয়। জমির মালিক চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। চসিকের কেন্দ্রীয় কবরস্থান, বুদ্ধিজীবী কবরস্থান ও মসজিদ কমপ্লেক্সের জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে এই মাদকসাম্রাজ্য।
সরেজমিনে চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ থানার আরেফিননগর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, চসিকের কেন্দ্রীয় কবরস্থান সংলগ্ন এলাকায় প্রকাশ্যে চলছে গাঁজা ও ইয়াবার বেচাকেনা। আরেফিননগরে চসিকের তিনটি ভাগাড় রয়েছে। এর মধ্যে দুটি বড় এবং একটি বায়োগ্যাস প্লান্টের পাশে। বড় দুটি ভাগাড়ের প্রবেশমুখে চসিকের জায়গায় মনিকাদের দোকান গড়ে উঠেছে।
সেই দোকান থেকে নিত্যপণ্যের মতোই কেনাবেচা হয় গাঁজা। কেউ কেউ এখান থেকে গাঁজা বা ইয়াবা কিনে সেবনের জন্য চলে যায় কেন্দ্রীয় কবরস্থান ও বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। স্থানীয়দের অভিযোগ, মনিকাদের দোকানসহ আশপাশের প্রায় সব দোকানেই মাদক বিক্রি হয়। মাদক রাখা থাকে ঘরে ঘরে। ক্রেতা এলে টাকার পরিমাণ অনুযায়ী মাদক তুলে দেওয়া হয় হাতে।
২০০৬ সালে চট্টগ্রামের কালুরঘাট এলাকায় কেটিএস পোশাক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৬৫ জন শ্রমিক নিহত হন। অজ্ঞাতপরিচয় শ্রমিকদের দাফনের জন্য সিটি করপোরেশন ওই এলাকায় গণকবরের ব্যবস্থা করে এবং সেটিকে চসিক কেন্দ্রীয় কবরস্থান ঘোষণা দেয়। পরে কবরস্থানের পাশের এলাকা বুদ্ধিজীবী কবরস্থান হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সেখানে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। নির্মাণ করা হয় সীমানাপ্রাচীর। মাটি ভরাট করে গড়ে তোলা হয় বাগান ও সবুজায়ন। নির্মিত হয় একটি মসজিদও।
একসময় সবুজে ঘেরা এই আরেফিননগরে চসিক ভাগাড় স্থাপন করলে দুর্গন্ধে অনেক বাসিন্দা এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন। এতে বিপাকে পড়ে হতদরিদ্র মানুষেরা। কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকায় তাঁরা বাপ–দাদার ভিটিতেই থেকে যান। তবে মাদকের ভয়াবহ প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
এলাকায় পুলিশের অভিযান বা গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিতি নজরদারিতে রাখা হয় তিন ডজনের বেশি সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে। সন্দেহ হলে পথচারী বা বহিরাগতদের জেরা করে নাজেহাল করা হয়। পুলিশের উপস্থিতি টের পেলে মাদক ড্রামে ভরে কবরের ভেতরে লুকিয়ে রাখা হয়। সর্বশেষ অভিযানে মনিকা গ্রেপ্তার হলে তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুরোনো কবর খুঁড়ে ড্রাম ভর্তি ইয়াবা ও গাঁজা উদ্ধার করে পুলিশ। মাদক ব্যবসার পাশাপাশি এখানে গড়ে উঠেছে একটি কিশোর গ্যাং। মোটরসাইকেলে ঘুরে বেড়িয়ে তারা এলাকায় ভয়ভীতি ছড়ায়। কেউ প্রতিবাদ করলে হামলার অভিযোগও রয়েছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের জিরো টলারেন্স নীতির কথা জানিয়ে উপকমিশনার আমিরুল ইসলাম বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর ওই এলাকায় একাধিক অভিযান চালিয়ে মনিকা গংয়ের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আবার সক্রিয় হলে পুনরায় অভিযান চালানো হবে। চসিকের ভূ-সম্পত্তির দায়িত্বে থাকা মেয়রের একান্ত সচিব মো. জিল্লুর রহমান বলেন, জায়গা দখলের বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চসিকের উপপ্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা প্রণব কুমার শর্ম্মা বলেন, পরিচ্ছন্নতা বিভাগে হরিজন শ্রেণির মানুষ কাজ করেন। তাঁদের জন্য কিছু শিথিলতা রয়েছে। তবে তা কাজের সময়ের বাইরে প্রযোজ্য নয়।
চসিকের জায়গা নিজেদের কেনা দাবি করে মাদকচক্রের অন্যতম সদস্য মুক্তা বেগম বলেন, জায়গাটি জসিম নামের একজনের কাছ থেকে কেনা হয়েছে। জসিমের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁর হার্টে রিং বসানো হয়েছে এবং তিনি কথা বলতে পারছেন না। মাদক মামলায় পরিবারের ছয়জন কারাগারে থাকার বিষয়টি স্বীকার করে মুক্তা বলেন, তাঁর স্বামী হযরত আলী, শাশুড়ি, মেয়ে, মেয়ের জামাই, বোন সেলিনা ও সেলিনার ছেলে বর্তমানে কারাগারে আছেন।
চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, বাসযোগ্য ও নিরাপদ নগর গড়তে মাদক ও কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চসিকের জায়গায় কোনো অবৈধ স্থাপনা থাকতে পারে না।

