বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ভেতরে গড়ে ওঠা একটি সংঘবদ্ধ চক্রের বিরুদ্ধে জাল ভিসা ও তথাকথিত ‘বডি কন্ট্রাক্ট’-এর মাধ্যমে যাত্রীদের ইউরোপ, যুক্তরাজ্য ও আমেরিকায় পাঠানোর গুরুতর অভিযোগ সামনে এসেছে। একই সঙ্গে যাত্রীদের লাগেজ কেটে মালপত্র গায়েব করে দেওয়ার ঘটনাতেও ওই চক্রের সম্পৃক্ততার তথ্য মিলেছে। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বিমানের ট্রাফিক শাখার কর্মকর্তা মিজানুর রহমান শিশিরকে এই চক্রের মূল ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি জাল ভিসা, মানবপাচার, বডি কন্ট্রাক্ট এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিলেন। তাঁর সহযোগী হিসেবে উঠে এসেছে বিমানের তৎকালীন চেকিং স্টাফ কৃষ্ণ সুধার নাম, যিনি বোর্ডিং পাস দেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন।
সূত্র জানায়, এইচএসসি পাসের সনদে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে বিমানে যোগ দেন শিশির। পরে ধাপে ধাপে ট্রাফিক শাখায় যুক্ত হয়ে বর্তমানে তিনি জুনিয়র গ্রাউন্ড সার্ভিস অফিসার পদে কর্মরত। দায়িত্বের এই অবস্থানকে কাজে লাগিয়েই তিনি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে কেন্দ্র করে একটি প্রভাবশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন বলে অভিযোগ।
বিমানের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে বিমান ২১টি আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এই রুটগুলোর মধ্যে কানাডা, ইতালি ও লন্ডনগামী ফ্লাইট ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে বডি কন্ট্রাক্টে যাত্রী পাঠানো হচ্ছিল। আগে এসব বিষয়ে গুঞ্জন থাকলেও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে গত ২৬ অক্টোবর জাল ভিসাধারী একজন যাত্রীকে হাতেনাতে আটক করার পর পুরো চিত্র সামনে আসে। ওই যাত্রীর দেওয়া তথ্য থেকেই শিশির ও কৃষ্ণ সুধার সম্পৃক্ততা স্পষ্ট হয়। এখন আরও কারা এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত, তা খুঁজে বের করতে কাজ করছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, অনেক ক্ষেত্রে যাত্রীরা শাহজালাল বিমানবন্দর পার হলেও গন্তব্য দেশে গিয়ে আটকে পড়তেন। তখন তারা সংশ্লিষ্ট দেশের ইমিগ্রেশনে না গিয়ে বিমানবন্দরের ‘অ্যাসাইলাম ডেস্কে’ রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করতেন। এই পর্যায়ে ভিসা বৈধ না অবৈধ—তা গুরুত্ব দিয়ে যাচাই করা হতো না। বরং আইনগত সহায়তা দেওয়া হতো। এই দুর্বলতাকেই কাজে লাগিয়ে বিমানবন্দরকেন্দ্রিক একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় ছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ট্রাফিক শাখায় যোগদানের পর শিশির লাগেজ কেটে যাত্রীদের মালপত্র চুরি, মানবপাচার, স্বর্ণ চোরাচালানসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। এমনকি ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দেশ ছাড়তেও তিনি সহায়তা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক পরিচয় ও প্রভাব ব্যবহার করে সহকর্মীদের বদলি বাণিজ্যেও তাঁর জড়িত থাকার তথ্য উঠে এসেছে।
এই অভিযোগগুলো সামনে আসার পর নড়েচড়ে বসে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। গত ২৫ নভেম্বর মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মাহফুজা জেরিন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। বিমান কর্তৃপক্ষ ৩০ নভেম্বর চিঠিটি পাওয়ার পর প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছে।
মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে শিশির প্রভাবশালী মহল ও বিমানের কিছু কর্মকর্তার সহায়তায় ইমিগ্রেশন ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে মানবপাচার চালিয়ে আসছিলেন। এরই অংশ হিসেবে গত ২৬ অক্টোবর ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে একজন যাত্রীকে জাল স্টাডি ভিসায় যুক্তরাজ্যে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়। যাত্রীর বোর্ডিং ও ইমিগ্রেশন সম্পন্ন হলেও আইএনএস গেটে সন্দেহ হওয়ায় তাঁকে অফলোড করা হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই যাত্রীর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সনদ বা ইংরেজি ভাষাজ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও কৃষ্ণ সুধা তাঁকে বোর্ডিং পাস দেন। আরও অভিযোগ রয়েছে, ছয় মাস আগে ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে কৃষ্ণ সুধাকে পছন্দের পোস্টিংয়ে আনেন শিশির। অতীতে দুজন একসঙ্গে সিলেট স্টেশনে কাজ করেছেন।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে শিশিরের অতীত কর্মকাণ্ডও তুলে ধরা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দায়িত্ব পালনকালে বিমান শ্রমিক লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই প্রভাব কাজে লাগিয়ে নিয়মিত দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া, বদলি বাণিজ্য এবং বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। একপর্যায়ে শাস্তিমূলকভাবে তাঁকে সৈয়দপুরে বদলি করা হলেও রাজনৈতিক তদবিরে আবার সিলেট স্টেশনে ফেরেন।
সিলেটে দায়িত্ব পালনকালে ভিজিট ভিসার আড়ালে মানবপাচার, সাধারণ যাত্রীদের হয়রানি এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগও উঠে এসেছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর ওসমানী বিমানবন্দর দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিদেশে পালাতে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছেন শিশির—এমন তথ্যও রয়েছে গোপন প্রতিবেদনে।
এ ছাড়া তাঁর স্ত্রীর মাধ্যমে সিলেটের এয়ারপোর্ট রোড এলাকায় ‘আবরার টেলিকম’ নামে একটি ট্রাভেল এজেন্সি অবৈধভাবে পরিচালনার অভিযোগও আছে, যা বর্তমানে বন্ধ। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে সিলেট মেট্রোপলিটন এয়ারপোর্ট থানায় মামলাও হয়েছে।
বর্তমানে মিজানুর রহমান শিশির বিমানের যশোর স্টেশনে কর্মরত রয়েছেন এবং কৃষ্ণ সুধা গ্রাউন্ডেড অবস্থায় আছেন। অভিযুক্তদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম জানিয়েছেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পাওয়ার পরপরই বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। অনুমোদন মিললেই তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে বিভাগীয় মামলা ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

