প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী সাইবার স্পেস সম্প্রসারিত হয়েছে। ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে এর ব্যবহার ছড়িয়ে পড়েছে। ইন্টারনেট সংযোগ জনজীবনকে সহজ করেছে, কাজের গতি বাড়িয়েছে এবং সময় সাশ্রয় করেছে।
তবে এর সঙ্গে বেড়েছে সাইবার অপরাধের ঝুঁকি। ম্যালওয়্যার, র্যানসামওয়্যার, হ্যাকিং-এর মাধ্যমে সাইবার অপরাধীরা গোপন তথ্য সংগ্রহ করে অর্থ লোপাট, মানব পাচার ও অন্যান্য অপরাধ ঘটাচ্ছে। সাইবার স্পেসকে অপরাধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বাড়ায় উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি করছে। এই ঝুঁকি মোকাবেলায় কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। এজন্য সবার সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে ‘কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট সাইবার ক্রাইম’ তৈরি করা হয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এটি গত বছরের ডিসেম্বরে অনুমোদন করে। ২৪ ডিসেম্বরকে সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ বছরের অক্টোবরে প্রায় ৭২টি দেশ এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে। এক দেশের মাধ্যমে অন্য দেশে সাইবার অপরাধ ঘটার ঝুঁকি থাকায়, স্বাক্ষরকৃত দেশগুলোকে প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। কঠোর নজরদারিও অপরিহার্য।
বাংলাদেশও সাইবার হামলার শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের ব্যাংক খাতে প্রতিদিন গড়ে চার শতাধিক সাইবার হামলা হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব হামলার মাত্র এক-চতুর্থাংশই চীন থেকে আসে। সম্প্রতি চীনও জাতিসংঘের কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে। ফলে সতর্ক থাকার প্রয়োজন রয়েছে। চীনের পর সাইবার হামলার উৎস হিসেবে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়াকে। সাইবার অপরাধ দেশের সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তাই আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও জরুরি।
দেশে সরকারি সেবা, ব্যাংক, বাণিজ্য, শিক্ষা—সবখানেই ডিজিটাল রূপান্তর ঘটেছে। কিন্তু এর সঙ্গে সমানভাবে বাড়ছে সাইবার হামলা, অনলাইন প্রতারণা, তথ্য চুরি ও সাইবার বুলিং। প্রধান কারণ হলো শক্তিশালী সাইবার নিরাপত্তা কাঠামোর অভাব এবং আইনের কার্যকর প্রয়োগ না থাকা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও এখন সাইবার অপরাধের বড় মাধ্যম। ফেসবুক আইডি হ্যাক, মিথ্যাচার বা ভুল তথ্য ছড়ানো, ডিজিটাল হয়রানি ও ব্ল্যাকমেইল, ম্যানিপুলেটেড ছবি শেয়ার—সবই নিয়মিত ঘটছে। সম্প্রতি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠানে হামলার আহ্বান জানানোও ঘটেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে ডিপফেক ও ভুয়া কনটেন্ট তৈরি করে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। দেশে চলমান সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতার একটি বড় কারণ হয়ে উঠেছে সাইবার স্পেসের অপব্যবহার।
ব্যাংক ও আর্থিক খাতেও সাইবার ঝুঁকি বাড়ছে। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) এবং অনলাইন ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে ফিশিং, ওটিপি চুরি, ভুয়া কল সেন্টার এবং অ্যাপ ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা ক্ষতিপূরণ বা ন্যায়বিচার পান না। এর ফলে ডিজিটাল আর্থিক ব্যবস্থায় জনগণের অনাস্থা তৈরি হচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে সাইবার নিরাপত্তায় প্রযুক্তির দক্ষ ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে আধুনিক সাইবার সিকিউরিটি অবকাঠামো, নিয়মিত সিস্টেম অডিট, ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ গড়ে তোলা জরুরি। সফটওয়্যার বা হার্ডওয়্যারের ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সাইবার সিকিউরিটি প্রটোকল অনুসরণ করা আবশ্যক।
আইনের কার্যকর প্রয়োগও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যমান সাইবার আইন ও বিধিমালা কার্যকর না হলে অপরাধীরা উৎসাহিত হবে। সাইবার অপরাধ তদন্তে দক্ষতা, ডিজিটাল ফরেনসিক সক্ষমতা এবং দ্রুতবিচার নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ভারসাম্যও বজায় রাখতে হবে। অতীতে সাইবার নিরাপত্তা আইন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হয়েছে, যা স্বাভাবিক নয়। সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫ জনস্বার্থে প্রয়োগ হতে হবে।
সাইবার নিরাপত্তা একটি সম্মিলিত দায়িত্ব। রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সবার সচেতন হওয়া দরকার। স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইবার নিরাপত্তা শিক্ষা, গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচার এবং নিয়মিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো যেতে পারে। বর্তমান ডিজিটাল যুগে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। না হলে ভবিষ্যতে ঝুঁকি আরও বেড়ে যাবে।

