রাশিয়ার কাজানে অনুষ্ঠিত ১৬তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে বুধবার নেতৃবৃন্দ জাতিসংঘের সংস্কারসহ বৈশ্বিক নানা ইস্যু নিয়ে একটি যৌথ ঘোষণাপত্র গ্রহণ করেছেন। এই সম্মেলনটি বৈশ্বিক অর্থনীতি, নিরাপত্তা এবং কূটনীতিতে নতুন দিকনির্দেশনা প্রদানের চেষ্টা করেছে, যেখানে মোট ১৩৪টি প্রবিধান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
সম্মেলনে গৃহীত ঘোষণা অনুযায়ী, ব্রিকস নেতারা জাতিসংঘের ব্যাপক সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের মতে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদসহ অন্যান্য সংস্থাগুলোর কাঠামোকে আরও গণতান্ত্রিক ও প্রতিনিধিত্বমূলক করতে হবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর কণ্ঠস্বর বিশ্বে আরও জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে, যাতে তারা বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আরও কার্যকরভাবে অংশ নিতে পারে।
ব্রিকস নেতারা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তাদের দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তারা দ্রুত জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় একটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবিরোধী কনভেনশন গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, এই কনভেনশন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।
সম্মেলনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবস্থাপনা নিয়েও আলোচনা হয়। ব্রিকস নেতারা জাতিসংঘকে এআই-এর বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান। এ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেনসহ বিশ্বজুড়ে চলমান সংঘাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তারা কূটনীতির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানের ওপর জোর দেন।
গাজা উপত্যকায় চলমান সংঘাত নিয়ে নেতারা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারা অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং সকল শত্রুতা বন্ধ করার আহ্বান জানান। সেইসঙ্গে ১৯৬৭ সালের সীমারেখার ভিত্তিতে ফিলিস্তিনের একটি সার্বভৌম ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গুরুত্বও উল্লেখ করেন। নেতারা জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদের প্রতি তাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন।
সম্মেলনে ইউক্রেন সংকট নিয়েও আলোচনা হয়। নেতারা কূটনৈতিকভাবে এই সংকট সমাধানের আহ্বান জানান। একইসঙ্গে তারা বিশ্ব অর্থনীতিতে একতরফা নিষেধাজ্ঞার বিরূপ প্রভাব নিয়েও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাদের মতে, এসব নিষেধাজ্ঞা বৈশ্বিক অর্থনীতি, শক্তি ও খাদ্য নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করছে এবং দরিদ্র দেশগুলোকে আরও বিপদে ফেলছে।
নেতারা মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতা রোধের ওপর জোর দেন। মহাকাশ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটি বৈশ্বিক দলিল তৈরির আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ভূমিকা বাড়াতে ব্রিকস নেতারা ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠানের সংস্কার এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি কাঠামো গড়ার প্রস্তাব দেন।
নেতারা একটি নতুন ব্রিকস বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন, যা ব্রিকস দেশ এবং গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোতে বিনিয়োগের প্রবাহ বাড়াবে। রাশিয়ার প্রস্তাবিত ব্রিকস শস্য বিনিময় গঠনের প্রস্তাবকেও তারা স্বাগত জানান। এই প্ল্যাটফর্মটি পরে কৃষি খাতের অন্যান্য ক্ষেত্রেও সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে।
এই সম্মেলনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ এল-সিসি, ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান এবং দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা উপস্থিত ছিলেন। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যোগ দেন।
সম্মেলনের পর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণকারী নেতাদের সম্মানে একটি জমকালো সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়।
এই শীর্ষ সম্মেলন ব্রিকস দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করেছে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতি ও রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা আরও প্রসারিত করার লক্ষ্যে একযোগে কাজ করার অঙ্গীকার করেছে।