বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের পরিমাণ চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত ঋণকে অতিক্রম করেছে। গত তিন বছরে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ প্রায় তিনগুণ বেড়ে আকাশচুম্বী অবস্থায় পৌঁছেছে, আর অন্যদিকে দেশে বৈদেশিক ঋণ প্রবাহ কমে এসেছে। একই সময়ে ঋণের মূল পরিশোধের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে এই বৃদ্ধির হার ৩২ শতাংশে সীমাবদ্ধ রয়েছে।
ঋণ চাপের প্রধান কারণ হিসেবে দেশে ঋণ গ্রহণের নীতির পরিবর্তনকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। আগের মতো সহজলভ্য না থাকায়, বাংলাদেশ এখন স্বল্প সুদের রেয়াতি ঋণ থেকে সরে গিয়ে বাজারভিত্তিক ঋণের ওপর বেশি নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছে। উল্লেখ্য, রেয়াতি ঋণের সুদের হার সাধারণত ২ শতাংশ বা তার কম হয়ে থাকে। বিশেষ করে, সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (সোফর)-ভিত্তিক ঋণের সুদ অর্ধেক বছরের মধ্যে ১ শতাংশের নিচে থাকলেও বর্তমানে তা সাড়ে ৫ শতাংশে পৌঁছেছে, যা দেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপকে অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ নতুন ঋণগ্রহণের চেয়ে বেশি হয়েছে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশটি ৮৪৬ মিলিয়ন ডলার নতুন ঋণ নিয়েছে কিন্তু সুদসহ পরিশোধ করতে হয়েছে ১.১৩ বিলিয়ন ডলার।
অর্থবছর ২০২১-২২ সালে দেশে সুদ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৪৯১ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসে প্রায় ১.৩৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে ঋণের মূল পরিশোধ ১.৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি হয়েছে। এর ফলে দুবছর আগের ৮.১৫ বিলিয়ন ডলার নিট ঋণ প্রবাহ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নেমে দাঁড়িয়েছে ৬.৫ বিলিয়ন ডলারে।
মার্কেট ভিত্তিক ঋণের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতার কারণে ঋণ পরিষেবা খরচও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজারভিত্তিক ঋণ বর্তমানে বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের ২৮.১ শতাংশ, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল মাত্র ১৫.৮ শতাংশ।
বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে মূলত দুই ধরনের ঋণ নেয়: নির্ধারিত সুদহারযুক্ত ঋণ এবং বাজারভিত্তিক ফ্লোটিং রেট ঋণ। এর মধ্যে দ্বিতীয়টি সোফর এবং ইউরোবর (ইউরো ইন্টারব্যাংক অফারড রেট)-এর সঙ্গে ওঠানামা করে। তিন বছর আগে সোফর ছিল ১ শতাংশের নিচে, ফলে বাজারভিত্তিক ঋণের প্রভাব ছিল সীমিত। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর এ হার বেড়ে সাড়ে ৫ শতাংশে পৌঁছায়, যদিও সম্প্রতি এটি ৪ দশমিক ৮ শতাংশে নেমেছে। বাংলাদেশকে এখন সোফর-ভিত্তিক ঋণের জন্য ৬ থেকে ৭ শতাংশ সুদ দিতে হচ্ছে।
ইউরোবরও গত তিন বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০২১ সালের গোড়ার দিকে এটি ঋণাত্মক শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ থেকে ২০২৪ সালের মাঝামাঝিতে ৩ শতাংশের বেশি হয়েছে। ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক ঋণের মূল পরিশোধ বার্ষিক ১৫ শতাংশ হারে বাড়লেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সুদ পরিশোধ বেড়েছে ৪৫.৫৯ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরে ছিল আরও বেশি — ৮৮.৭১ শতাংশ।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে রেয়াতি ঋণ কমে আসার কারণে ঋণ পরিষেবার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক মনজুর হোসেন বলেন, “শুধু ঋণ প্রবাহ বেড়ে যাচ্ছে বা কমছে তা বিবেচ্য নয় বরং ভবিষ্যতের ঋণ অর্থায়নে আরও সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। আমরা যে ধরনের ঋণ নিচ্ছি, তার সুদের হারগুলো যাচাই করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ঋণের অর্থ দুর্নীতি ও অপচয় রোধ করে সঠিক প্রকল্পে বিনিয়োগে ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, বাজারভিত্তিক সুদহারের ভিত্তিতে বাংলাদেশ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ গ্রহণ করে। গত অর্থবছরে এডিবিকে সুদ বাবদ ৫১৮.৭৪ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এডিবির সঙ্গে মোট ঋণচুক্তির পরিমাণ ছিল ২.৯৪ বিলিয়ন ডলার, যার প্রায় অর্ধেক — ৪৯.৪৫ শতাংশ ছিল বাজারভিত্তিক সুদে।
অন্যদিকে, বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে গত অর্থবছরে পাওয়া ৯০ মিলিয়ন ডলার ঋণও বাজারভিত্তিক সুদহারে নেওয়া হয়েছিল। এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে বাংলাদেশের নেওয়া ঋণের সবই বাজারভিত্তিক সুদে হওয়ায় গত অর্থবছরে উচ্চ সুদহারের কারণে এআইআইবি থেকে কোনো প্রকল্প-ঋণ নেওয়া হয়নি। তবে রিজার্ভের সহায়ক হিসেবে বাজেট সহায়তা চুক্তির আওতায় এআইআইবি থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ।
বর্তমানে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত ঋণকে ছাড়িয়ে গেছে। জুলাই-সেপ্টেম্বরে সুদ ও মূল পরিশোধের পর বৈদেশিক সাহায্যের নিট প্রবাহ দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ২৭৯ মিলিয়ন ডলারে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছরের জুলাই–সেপ্টেম্বরে বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ২৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ে মূল পরিশোধ বেড়ে ৬৮৫.৫ মিলিয়ন ডলার এবং সুদ পরিশোধ বেড়ে ৪৪১ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের বছর একই সময়ে ছিল যথাক্রমে ৪৯২ মিলিয়ন ও ৩৭৮.৪৬ মিলিয়ন ডলার।
ইআরডি এবং সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)-এর পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশের মোট বৈদেশিক ঋণের ২৬ শতাংশ বাজারভিত্তিক সুদে ছিল, যা ২০৪১ সালে ৮২ শতাংশের বেশি হবে। সরকারি দাতাদের কাছ থেকে পাওয়া রেয়াত সুবিধার ঋণ হ্রাস পাওয়ায় ঋণ পরিষেবা খরচও ক্রমশ বাড়বে বলে ইআরডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইডিএ)-এর রেয়াতি ঋণ এবং এডিবি-র অর্ডিনারি ক্যাপিটাল রিসোর্সেস (ওসিআর)-এর ঋণ সমন্বয় করে ঋণ নিচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাংক ও এডিবি-র পর অন্যান্য বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগীরাও আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশে ছাড় দেওয়া ঋণের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমিয়ে আনবে।