বর্তমান বিশ্বে টেকসই উন্নয়ন এবং পরিবেশ রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশগত বিপর্যয় এবং সামাজিক অস্থিতিশীলতার কারণে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি নীতির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ২০১৫ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ সদস্য দেশগুলোর জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করে।বিভিন্ন সমস্যা যেমন দারিদ্র ,জলবায়ু পরিবর্তন ,জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি এবং শান্তি প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা তার উদ্দেশ্যেই এই পরিকল্পনার প্রণয়ন। এটি এমন একটি উন্নয়ন যা ভবিষ্যত প্রজন্মের নিজস্ব চাহিদা মেটাতে সক্ষমতার সাথে আপস না করে বর্তমানের চাহিদা পূরণ করে।
জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক সম্পদের সংকট এবং সামাজিক বৈষম্য মোকাবেলায় টেকসই উন্নয়ন একটি কার্যকর সমাধান। আর এ প্রেক্ষাপটে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি নীতির গুরুত্ব অপরিসীম।
টেকসই উন্নয়ন কী-
কসই উন্নয়ন কী-টেকসই উন্নয়ন এমন একটি বিনিয়োগ কার্যক্রম যা প্রাকৃতিক বা সামাজিক সম্পদের কোন ক্ষতি সাধন ছাড়াই অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত সাফল্য অর্জনে সহায়তা করে। এতে নবায়নযোগ্য শক্তি, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি এবং সামাজিক উন্নয়নমূলক প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, সৌর ও বায়ু শক্তি উৎপাদনের প্রকল্পগুলো টেকসই উন্নয়নের অংশ। একটি উদাহরণ হতে পারে সৌরশক্তি ব্যবহার। গ্রামীণ অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহে অনেক সময় সমস্যা হয়। সেখানে সৌর প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব, যা পরিবেশবান্ধব এবং নবায়নযোগ্য। এটি পরিবেশ দূষণ না করে দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুৎ সরবরাহের একটি কার্যকর পদ্ধতি, যা স্থানীয় মানুষদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমাতে সাহায্য করে।
টেকসই উন্নয়নে সরকারের ভূমিকা-
সরকারের দীর্ঘমেয়াদি নীতি টেকসই উন্নয়নকে নানাভাবে প্রভাবিত করে । এ উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নের সরকারেরও যথাযথ ভূমিকা ও দায়িত্ব রয়েছে। যেমন বলা যায়, সরকারের কঠোর পরিবেশগত বিধিমালা ব্যবসায়ীদের টেকসই পদ্ধতিতে পরিচালনার জন্য বাধ্য করে। এই নিয়মগুলো পরিবেশ রক্ষায় সহায়তা করে।
সরকার টেকসই প্রকল্পগুলোর জন্য কর ছাড়, সাবসিডি ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। সাবসিডি হলো সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পণ্য, সেবা বা খাতের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করা, যা সাধারণত সেই পণ্য বা সেবার মূল্য কম রাখতে সাহায্য করে। এটি ভর্তুকি হিসেবেও পরিচিত। এটি বিনিয়োগকারীদের তাদের বিনিয়োগকে লাভজনক করে।
সরকার উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়নে বাজেট থেকে বরাদ্দ দিয়ে গবেষণা ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করে, যা নতুন প্রযুক্তি ও ধারণার বিকাশ ঘটায়।
জনগণের মধ্যে টেকসই বিনিয়োগের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করাও সরকারের দায়িত্ব।
টেকসই উন্নয়নের সুবিধা-
টেকসই উন্নয়নেরমাধ্যমে বিভিন্ন সুবিধা অর্জন করা সম্ভব। যা বিভিন্ন পরিবেশ ও সামাজিক সম্পর্কে সুরক্ষা দানের পাশাপাশি উন্নয়নের সুফল প্রদানেও ভূমিকা রাখবে।
টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন পানি, মাটি, বন ইত্যাদি মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ করা যায়, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করে। টেকসই উন্নয়নের পরিকল্পনা হিসেবে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে দূষণ কমিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। এছাড়া টেকসই উন্নয়ন স্থানীয় ও বৈশ্বিক অর্থনীতিকে দীর্ঘমেয়াদে সমৃদ্ধ করে। যা নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এবং দারিদ্র্য হ্রাসে ভূমিকা রাখে।
এ উন্নয়নের মাধ্যমে সমাজের সব স্তরের মানুষ উপকৃত হয়। এটি নারী, শিশু ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নে সাহায্য করে। এ উন্নয়নের সাহায্যে পরিবেশ দূষণ কমানোর মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং মানুষ একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে পারে। টেকসই উন্নয়ন জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব কমিয়ে আনে, যেমন উষ্ণায়ন, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি ও খরা আদি মোকাবেলা সাহায্য করে কেননা এই উন্নয়নের মাধ্যমে পরিবেশের প্রতি ও লক্ষ্য রাখা হয়।
এভাবে, টেকসই উন্নয়ন বর্তমান প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্যও একটি সুস্থ ও সমৃদ্ধ পরিবেশ নিশ্চিত করে।
বৈশ্বিক উদাহরণ-
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টেকসই বিনিয়োগের উদাহরণ দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, নরওয়ে তার তেল ও গ্যাসের আয় থেকে একটি ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছে, যা টেকসই প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ করছে। এছাড়া, কানাডা তার পরিবহন ব্যবস্থাকে বৈদ্যুতিক ও নবায়নযোগ্য শক্তিতে রূপান্তরের জন্য ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। যা এ দুটি দেশের উন্নয়নকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করছে।
চ্যালেঞ্জ-
টেকসই বিনিয়োগে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন অনেক সময় প্রাথমিক বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত তহবিলের অভাব দেখা যায়। জনগণের মধ্যে টেকসই বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা কম থাকতে পারে। এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করে। এক্ষেত্রে দারিদ্র্য একটি প্রধান বাধা, যা মানুষকে টেকসই বিকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। তাছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধি সম্পদের উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং খাদ্য, পানি ও বাসস্থানের অভাব তৈরি করে। পরিবেশ দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ, যা প্রাকৃতিক সম্পদ ও স্বাস্থ্যকে বিপদে ফেলে।
প্রযুক্তিগত অগ্রগতির অভাব এবং সঠিক নীতির অভাবও সমস্যার সৃষ্টি করে। অনেক সময় স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলো কার্যকর হয় না। বৈশ্বিক সহযোগিতা এবং অর্থনৈতিক সমতার অভাব টেকসই উন্নয়নের পথে বাধা তৈরি করে। এই সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা একসঙ্গে আমাদের একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
পরিশেষে, টেকসই বিনিয়োগ একটি কার্যকরী পদক্ষেপ, যা সরকারের দীর্ঘমেয়াদি নীতির মাধ্যমে সফলভাবে বাস্তবায়িত হতে পারে। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত সাফল্য নিশ্চিত করার জন্য সরকারের উচিত কার্যকর নীতি গ্রহণ করা এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। টেকসই বিনিয়োগের মাধ্যমে একটি সুষম ও উন্নত সমাজ গঠনের পথ প্রশস্ত হবে।